পাতা:জোড়াসাঁকোর ধারে.djvu/২২

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
জোড়াসাঁকোর ধারে
১৫

সামনে নৈবেদ্য সাজিয়ে মুনি চোখ বুজে ধ্যানে বসে আছেন, চুপি চুপি কৃষ্ণ হাত ডুবিয়ে পায়েসটুকু তুলে মুখে দিচ্ছেন, হুবহু কথকঠাকুরের গল্পের ছবি; শকুন্তলার ছবি—তিনটি মেয়ে বনের ভিতর দিয়ে চলেছে, শকুন্তলা বলে বুঝতুম না, তবে ভালো লাগত দেখতে; মদনভস্মের ছবি—মহাদেবের কপাল ফুঁড়ে ঝাঁটার মতো আগুন ছুটে বের হচ্ছে; সরোজিনী নাটকের ছবি; কাদম্বরীর ছবি—রাজপুত্তুর পুকুরধারে গাছতলায় ঘোড়া বেঁধে শিবমন্দিরের দাওয়ায় বসে আছে। কে জানে তখন, সেটা কাদম্বরীর ছবি। এমনি কত সব ছবি। কেষ্টনগরের পুতুলই বা কত রকমের ছিল সেই ঘরে। চেয়ে চেয়ে দেখতে বেলা কাটে। মেঝেতে ঢালা-বিছানায় বুকে বালিশ দিয়ে বসে ছোটপিসিমা পান খান, সেলাই করেন। ও-বাড়িতে বেলা তিনটের ঘণ্টা পড়ে। গুপীদাসী চুল বাঁধার বাক্স, মাদুর নিয়ে আসে। ছোটপিসিমা উঠে উঁচু-পাঁচিল-ঘেরা ছাদে গিয়ে চুল বাঁধতে বসেন, পোষা পায়রাগুলো খোপ থেকে বেরিয়ে এসে ছোটপিসিমাকে ঘিরে ঘাড় নেড়ে বকম বকম বকে বকে নাচ দেখায়। ছোটপিসি আমার হাতে মুঠো মুঠো দানা দেন; ছড়িয়ে দিই, তারা চক্কর বেঁধে কুড়িয়ে কুড়িয়ে খেয়ে উড়ে বসে ছাদের কার্নিশে সারি সারি। পড়ন্ত রোদ তাদের ডানায় ডানায় ঝকমক করে। কোনো কোনো দিন বা দেখি ঘূর্নি হাওয়ায় লাল ধুলো পাক খেয়ে খেয়ে উড়ে গেল। বাইরের ছবিও দেখি। আবার খেলাধুলোর শেষে ঘরের কোণায় সন্ধ্যেবেলা পিতলের পিলসুজের উপর পিদিম জলে, তারই কাছে টিকটিকি নড়েচড়ে পোকা ধরে, তাও দেখি চেয়ে চেয়ে অনেকক্ষণ। এইরকম ঘর-বাইরের কত কি ছবি দেখতে দেখতে বেড়ে উঠেছি।

 ভিতর দিকটা দেখবার কৌতুহল আমার ছেলেবেলা থেকে আছে। বন্ধ ঘরের ভিতরটা, ঘেরা বাগানের ভিতরটা, দেখতে হবে কি আছে ওখানে। খেলনা, দম দিলে চলে চাকা ঘোরে; দেখতে চাই ভিতরে কি আছে। এই সেদিন পর্যন্তও ছেলেদের খেলনা নিয়ে খুলে খুলে আবার মেরামত করেছি। ছেলেদের খেলনা হাতে নিলেই মা বলতেন, “ওই রে এবার গেল জিনিসটা, ভিতর দেখতে গিয়ে ভাঙবে ওটি।’ তা ছেলেবেলায় একবার ভিতর দেখতে গিয়ে কী কাণ্ডই হয়েছিল শোনো।

 বড়মা থাকেন তেতলার একটি ঘরে। তাঁরও নানারকম পাখি পোষার শখ। পোষা টিয়ে, পোষা লালমোহন হীরেমোহন; লালমোহনের দাঁড়টি আগাগোড়া ঝকঝক তকতক করছে সোনালি রঙে। ঘরের একপাশে এক আলমারি বোঝাই