মাজছে।’ রামলালের হাত ছিল নরম। কি কারণে তাকে ছেড়ে দিয়েছিলেন জানিনে; বোধ হয় দেশে গিয়ে ফিরতে দেরি করেছিল। যা হোক আমি তো পড়লুম তার চার্জে। সব ছেলেদের একটি করে চাকর থাকে। তারাই যেন মাস্টার। আদবকায়দা শেখায়, চোখে চোখে রাখে। কারণ, ছেলেরা কিছু করলে দোষ চাকরদেরই। চাকরদের কাছেই জিম্মে থাকে ছেলেদের এক-একজনের এক-একটি আলমারি, তাতে যার যার কাপড়জামা, থালাবাসন, ব্যবহারের যাবতীয় বস্তু। চাবিও থাকে চাকরদের কাছেই। দরকারমত বের করে দেয়, আবার ধুয়ে মুছে সাফ করে তুলে রাখে। দুধ খাবার বাটিও থাকে বাড়ির ভিতরে দাসীর কাছে।
তোশাখানা শুধু চাকরদের থাকবার জন্যে, বেয়ারারা থাকে অন্যদিকে। ঘরের উত্তরে দক্ষিণে দু-দিকে দু-সারি আলমারি কাপড়ে বাসনে বোঝাই। পুবে পশ্চিমে কয়েকখানা বড় বড় তক্তা পাতা, তক্তার মাঝখানে একটি করে বাক্স বসানো। ডালা খুলে দেখি, তাদের খেলার দাবার ছক, তাস, আয়না, চিরুনি, এই সব নানা জিনিসপত্রে ভরা। সেই তক্তার উপরেই মাদুর বালিশ বিছিয়ে তারা ঘুমোয়। আবার কোনো কোনো দিন দেখি, বাবামশায়দের বৈঠক ভাঙলে তারা ফিটফাট বাবু সেজে রুপোর ট্রেতে করে সোডা লেমনেড খায়, রুপোর পেয়ালায় চা পান করে। বাবুদের আড্ডা ভাঙলে তাদের আড্ডা শুরু হয়।
সে-বয়সে চাকরদের তোশাখানায় যখন-তখনই যেতে পারি, সেখানে যাবার আমার ফ্রী লাইসেন্স, কেউ বারণ করে না। রামলাল বলে, ‘এসেছ? আচ্ছা, থাকো এখানেই।’ তাদেরই তেলচিটচিটে বালিশ মাথায় দিয়ে শুয়ে পড়ি। পাশে রামলাল বসে বাবামশায়ের ধুতি পাট করে দেয় দেখি, দেখতে দেখতে ধুতি চুনোট করে যখন ছেড়ে দেয় ফুলের মত ছড়িয়ে পড়ে।
তোশাখানার পাশে উত্তর দিকটায় ভিস্তিখানা। চানের ঘরে যেতে হয়। ভিস্তিখানার ভিতর দিয়ে, বড় হয়েছি, সাতে পড়েছি; এখন তো আর বারান্দায় বসে হাতমুখ ধুলে চলবে না। চাকর তরিবত শেখাচ্ছে। সকালে উঠে চানের ঘরে গিয়ে হাতমুখ ধোয়া অভ্যেস করতে হচ্ছে। একটিই চানের ঘর নিচে। দাদারা ঢুকছেন এক এক করে। তাদের শেষ না হলে তো আর আমি ঢুকতে পারিনে। অপেক্ষা করছি ভিস্তিখানায়। খুব ভোরেই উঠতে হয় আমাদের। বসে বসে দেখছি।