পাতা:জোড়াসাঁকোর ধারে.djvu/৫৩

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
৪৬
জোড়াসাঁকোর ধারে

ধাতুমূর্তি আকাশের দিকে হাত তুলে, উঁচু হয়ে ফোয়ারা থেকে জল পড়ছে, আশেপাশে পাখিরা গাইছে, ফুলের সুবাস ভেসে আসছে; তারই মাঝে বাবামশায় বসে। মস্ত বড় একটা বিল তৈরি হল একপাশে। যখন কাটা হত দেখতুম মাঝে মাঝে মাটির স্তম্ভ দাঁড়িয়ে আছে পর পর। শ’য়ে শ’য়ে লোক মাটি কাটছে, ঝুড়িতে করে এনে ফেলছে পাড়ে। সেই ঝিল একদিন ভরে উঠল তলা থেকে ওঠা নতুন জলের লহরে। দলে দলে হাঁস চরে বেড়ায়। ঝিলের এক পারে প্রকাণ্ড একটি বটগাছ, তলায় সারস সারসী, ময়ূর ময়ূরী, রুপোলি সোনালি মরাল দলে দলে খেলা করে। তার ওদিকে হরিণবাগান; পালে পালে হরিণ একদিক থেকে আর একদিকে ছুটে বেড়াচ্ছে। তার ও-দিকে মাঠভরা ভেড়ার পাল; তার পর গেল গোরু, মোষ, ঘোড়া, তার পর হল শাকসবজি তরিতরকারি নানা ফসলের খেত। এই গেল একদিকের কথা। আর একদিকে ফুলের বাগান, বাগানে সুন্দর সুন্দর খাঁচা। সে কি খাঁচা যেন এক-একটি মন্দির; সোনালি রঙ, তাতে নানা জাতের রঙবেরঙের পাখি, দেশবিদেশ থেকে আনানো, বাবামশায়ের বড় শখের। বাগানের পরে খেলার মাঠ। তার পর আম কাঁঠাল লিচু পেয়ারার বন; তার পর আরো কত কি, মনেও নেই সব। বাগান তো নয়, একটা তল্লাট। ফ্রেঞ্চ টেরিটরি থেকে আরম্ভ করে বদ্দিবাটির মিলের ঘাট অবধি ছিল সেই বাগানের দৌড়।

 সেই তল্লাট দু-মাসের মধ্যেই বাবামশায় সাজিয়ে ফেললেন। অনেক মূর্তির ফরমাশ হল বিলেতে। একটা ব্রোঞ্জের ফোয়ারার অর্ডার দিলেন, পছন্দমত নিজের হাতে এঁকে। পুকুরপাড়ে বোধ হয় বসাবার ইচ্ছে ছিল। ফোয়ারাটি যেন একগোছা ঘাস; তেমনি রঙ, দূর থেকে দেখলে সত্যিকারের ঘাস বলেই ভ্রম হয়। তখনকার দিনে ইণ্ডিয়ান আর্ট বলে তো কিছু ছিল না, বিলিতি আর্টেরই আদর হত সবখানে। পরে আমরা দেখি টি. টমসনের দোকানে বিলেত থেকে তৈরি হয়ে এসেছে সেই ফোয়ারা আর দুটি মানুষপ্রমাণ ক্রীতদাসীর ধাতুমূর্তি বাবামশায়ের ফরমাশি জিনিস। ইণ্টারন্যাশন্যাল একজিবিশন হয়, সেখানে তা সাজানো হল। প্রত্যেকটি ঘাসের মুখ দিয়ে ফোয়ারা ছুটছে তালগাছ সমান উঁচু হয়ে। ছ হাজার টাকা শুধু সেই ফোয়ারাটির দাম। সেই একজিবিশন থেকে ফোয়ারাটি মূর্তিটি কোন দেশের এক রাজা কিনে নিলেন। ভালো ভালো ফুলদানি, কাচের ফুলের তোড়া, দেখলে তাক লাগে। জ্যেঠামশায় এলেন পলতার বাগানে; বাবামশায় ঘুরে ঘুরে তাকে সব দেখাতে লাগলেন।