ফিরিয়ে নিলেন। মাথা কাত হয়ে পড়ল বালিশে। বড়পিসিমা ছোটপিসিমা চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘এ কি, এ কি হল! কাল-জ্যৈষ্ঠ এল রে কাল-জ্যৈষ্ঠ।’
সেইদিন থেকে ছেলেবেলাটা যেন ফুরিয়ে গেল।
৭
তার পর গেল বেশ কিছুকাল। একদিন বিয়ে হয়ে গেল, সঙ্গে সঙ্গে জীবনের ধরনধারণ ওঠাবসা সাজগোজ সব বদলে গেল। এখন উলটো জামা পরে ধুলো পায়ে ছুটোছুটি করবার দিন চলে গেছে। চাকরবাকররা ‘ছোটবাবু মশায়’ বলে ডাকে, দরোয়ানরা ‘ছোট হুজুর’ বলে সেলাম করে। দু-বেলা কাপড় ছাড়া অভ্যেস করতে হল, শিমলের কোঁচানো ধুতি পরে ফিটফাট হয়ে গাড়ি চড়ে বেড়াতে যেতে হল, একটু আধটু আতর ল্যাভেণ্ডার গোলাপও মাখতে হল, তাকিয়া ঠেস দিয়ে বসতে হল, গুড়গুড়ি টানতে হল, ড্রেসসুট বুট এঁটে থিয়েটার যেতে হল, ডিনার খেতে হল, এককথায় আমাদের বাড়ির ছোটবাবু সাজতে হল।
বাল্যকালটাতে শিশুমন কি সংগ্রহ করলে তা তো বলে চুকেছি অনেকবার অনেক জায়গায়, অনেকের কাছে। যৌবনকালের যেটুকু সঞ্চয় মন-ভোমরা করে গেছে তার একটু একটু স্বাদ ধরে দিয়েছি, এখনো দিয়ে চলেছি হাতের আঁকা ছবির পর ছবিতে। এ কি বোঝো না? পদ্মপত্রে জলবিন্দুর মত সে সব সুখের দিন গেল। তার স্বাদ পাওনি কি ওই নামের ছবিতে আমার। প্রসাধনের বেলায় জোড়াসাঁকোর বাড়িতে অন্দরমহলে যে সুন্দর মুখ সব, যে ছবি সব সংগ্রহ করলে মন, আমার ‘কনে সাজানো’ ছবিখানিতে তার অনেকখানি পাবে। সুখের স্বপ্ন ভাঙানো যে দাহ সেও সঞ্চিত ছিল মনে অনেকদিন আগে থেকে। সুখের নীড়ে বাসা করেছিলেম, তবেই তো আঁকতে শিখে সে মনের সঞ্চয় ধরেছি ‘সাজাহানের মৃত্যুশয্যা’ ছবিতে।
বাল্যে পুতুল খেলার বয়সের সঞ্চয় এই শেষবয়সের যাত্রাগানে, লেখায়, টুকিটাকি ইঁটকাঠ কুড়িয়ে পুতুল গড়ায় যে ধরে যাচ্ছিনে তা ভেবে না। সেই বাল্যকাল থেকে মন সঞ্চয় করে এসেছে। তখনই যে সে সব সঞ্চয় কাজে লাগাতে পেরেছিলেম তা নয়। ধরা ছিল মনে। কালে কালে সে সঞ্চয় কাজে এল; আমার লেখার কাজে, ছবি আঁকার কাজে, গল্প বলার কাজে, এমনি কত কি কাজে তার ঠিক নেই। এই নিয়মে আমার জীবনযাত্রা চলেছে। আমার সঞ্চয়ী মন। সঞ্চয়ী মনের কাজই এই—সঞ্চয় করে চলা, ভালো মন্দ টুকিটাকি কত কি! কাক যেমন অনেক মূল্যবান জিনিস, ভাঙাচোরা অতি বাজে জিনিসও