পাতা:টোকিও বেতার বক্তৃতা - সুভাষচন্দ্র বসু.ogg

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 স্বদেশবাসী বন্ধুগণ, এই মাসের একুশ তারিখে টোকিও রেডিও হইতে আমি বর্তমান যুদ্ধ-পরিস্থিতির বিষয়ে আপনাদিগকে কিছু বলিয়াছিলাম। আজ আমার ইচ্ছা যে গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাস হইতে পৃথিবীর বিভিন্ন রেডিও স্টেশন হইতে যাহা বলিয়া আসিয়াছি, তাহার পুনরাবৃত্তি করা। সর্বপ্রথমে আমি এই প্রশ্ন তুলিতে চাই যে বর্তমান যুদ্ধের প্রকৃত অর্থ কী, এবং এই বিশ্ব-সংঘাতের পশ্চাতে কোন্ কোন্ শক্তি ক্রিয়া করিতেছে?

 বন্ধুগণ, এই যুদ্ধে আমরা দুই বিশ্বশক্তির সংঘর্ষ দেখিতেছি। একদিকে পুরাতন রাজশক্তিপুঞ্জ, যাহারা নিজেদের কায়েমি স্বত্ব বজায় রাখিতে চায়। তাহাদের বিরুদ্ধে কতকগুলি নূতন রাজশক্তি দেখিতেছি, যাহারা কায়েমি স্বত্ব ধ্বংস করিয়া পৃথিবীতে এক নূতন ব্যবস্থা আনিতে চায়। প্রথম দলে আমরা স্বাধীনতা ও প্রজাতন্ত্রের মুখোশধারী অ্যাংলো-অ্যামেরিকান সাম্রাজ্যবাদকে দেখিতেছি। যদি এই সাম্রাজ্যবাদের বিজয় হয়, তাহা হইলে ভারতের পরাধীনতা চিরস্থায়ী হইবে এবং সঙ্গে সঙ্গে আরও অনেক দুর্ভাগ্য জাতির দাসত্ব-শৃঙ্খল সুদৃঢ় হইবে।

 কোন কোন ভারতবাসী পূর্বে আশা করিয়াছিলেন যে বর্তমান যুদ্ধের চাপে ইংরাজের মত সাম্রাজ্যবাদীরা ভারতের ন্যায় পদানত জাতিদের স্বাধীনতার দাবি স্বীকার করিতে বাধ্য হইবে। কিন্তু এই আশা দুরাশায় পরিণত হইয়াছে। অপরদিকে যেসব ব্যক্তি প্রাণপণ চেষ্টা করিয়াছিলেন উভয়পক্ষের মধ্যে একটা আপস করাইয়া এই বিশ্বযুদ্ধ নিবারণ করিতে, তাঁহাদের সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হইয়াছে। অতএব এই সংগ্রামে আপসের কোন সম্ভাবনা নাই, এবং যতদূর দেখা যাইতেছে, গত বিশ্বযুদ্ধ অপেক্ষা বর্তমান যুদ্ধ আরও বেশিদিন চলিতে পারে।

 এই ঐতিহাসিক ঘাত-প্রতিঘাতের সময় আমাদের কর্তব্য কী? আমাদের কর্তব্য নবীন জাতিদের পক্ষ অবলম্বন করা, কারণ তাহারা যদি বর্তমানের অচলায়তন ধ্বংস করিতে পারে, তাহা হইলে এই ওলট-পালটের মধ্যে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করিবার এক সুবর্ণ-সুযোগ লাভ করিব।

 একথা আপনারা সহজে উপলব্ধি করিবেন যে অ্যাক্সিস শক্তিরা অর্থাৎ জাপান, জার্মানি ও ইটালি আমাদের চিরশত্রু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে আক্রমণ ও দুর্বল করিয়া পরোক্ষভাবে আমাদেরই সাহায্য করিয়াছে। তাহারা যদি এইভাবে আমাদের শত্রুকে কাবু না করিত, তাহা হইলে আমাদের কাজ শতগুণে কঠিনতর হইত। এই সাহায্যের জন্য আমাদের কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের আরও কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত যে অ্যাক্সিস শক্তিরা প্রত্যক্ষভাবেও আমাদের জাতীয় সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতি দেখাইতেছে। এবং তাহারা সকল প্রকার সহায়তা দিতেও সর্বদা প্রস্তুত আছে।

 আমি জানি যে ইংরাজি শিক্ষা ও ইংরাজের প্রোপাগাণ্ডার প্রভাবের দরুণ কতিপয় ভারতবাসী অ্যাক্সিস শক্তিদের সততার ব্যাপারে অত্যন্ত সন্দিহান। এই সব দেশবাসীদের আমি অনুরোধ করিতে চাই তাঁহারা যেন আমায় বিশ্বাস করেন। আমি তো আমাদের জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে কিছু করিব না! এবং আমাকে কেহ প্রতারিত করিতেও পারিবে না। প্রবল-পরাক্রান্ত ব্রিটিশ রাজ সারা জীবন আমাকে নির্যাতন করিয়া এবং এগারো বার আমাকে কারারুদ্ধ করিয়াও যখন আমাকে কাবু করিতে পারিল না, তখন আর কোন পার্থিব শক্তি তাহা করিতে পারিবে না। এবং চালাক-চতুর ও ক্রূর প্রকৃতির ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ্ যখন আমাকে প্রলুব্ধ বা প্রতারিত করিতে পারিল না, তখন পৃথিবীতে আর কেহ তাহা করিতে পারিবে না।

 বন্ধুগণ, আপনারা জানেন যে ১৯৪০ সালের শেষদিকে আমি যখন দেখিলাম যে মহাত্মা গান্ধী পরিশেষে সত্যাগ্রহ সংগ্রাম আরম্ভ করিয়াছেন, আমি তখন অনুভব করিলাম যে এখন পৃথিবীর সম্মুখে ভারতের মান-মর্যাদা রক্ষা হইল। এবং অতঃপর ভারতের বিপ্লব আন্দোলন এরূপ ব্যাপকভাবে এবং নূতন প্রণালীতে চালাইতে হইবে যাহাতে আমাদের স্বাধীনতার প্রচেষ্টা সার্থক ও সাফল্যমণ্ডিত হয়। এই উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্য তিনটি বস্তুর একান্ত প্রয়োজন আমি অনুভব করি। প্রথমত, বিশ্ব-পরিস্থিতি এবং বিশেষ করিয়া যুদ্ধ-পরিস্থিতির নিরপেক্ষ ও সঠিক সংবাদ সংগ্রহ করা। দ্বিতীয়ত, অ্যাক্সিস শক্তিদের সহিত সংযোগ স্থাপন করা এবং তৃতীয়ত, প্রবাসী ভারতবাসীদের সহায়তা সংগ্রহ করা।

 বন্ধুগণ, আজ আমি সানন্দে আপনাদিগকে জানাইতে পারি যে আমার এই তিনটি উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইয়াছে। বিশ্ব-পরিস্থিতির সঠিক খবর আমরা পাইয়াছি এবং পাইতেছি। পাইয়া আমাদের এই ধারণা বদ্ধমূল হইয়াছে যে অন্তিমে আমাদেরই জয় এবং ইংরাজের পরাজয় হইবে। দ্বিতীয়ত, আমরা বুঝিয়াছি যে অ্যাক্সিস শক্তিরা এবং বিশেষ করিয়া জাপান ভারতের বাহিরে ভারতবাসীর স্বাধীনতা-সংগ্রামের সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু ও সহায়ক। তৃতীয়ত, আমাদের শত্রু কর্তৃক অধিকৃত দেশে ছাড়া যত ভারতবাসী আজ ভারতের বাহিরে প্রবাসে আছেন, তাঁহারা সকলেই এক বিরাট আন্তর্জাতিক সঙ্ঘে সুসংবদ্ধ হইয়াছেন। তাঁহারা একদিকে ভারতের আভ্যন্তরীণ ঘটনাবলীর সহিত সংযোগ রাখিতেছেন এবং অপর দিকে আন্তর্জাতিক ব্যাপারের সহিত সংশ্লিষ্ট আছেন। যাঁহারা ইংরাজের সকল প্রকার অত্যাচার, নির্যাতন ও নৃশংসতা অগ্রাহ্য করিয়া ভারতের ভিতরে মুক্তির সংগ্রাম চালাইয়া আসিতেছেন, ঠিক সময় তাঁহাদের নিকট প্রয়োজনীয় সাহায্য পৌঁছাইয়া দিবার জন্য প্রবাসী ভারতবাসীদের প্রতিষ্ঠান এখন সকল আয়োজন করিতেছে।

 বন্ধুগণ, আপনাদের নিশ্চয়ই স্মরণ থাকিবে যে আমি ইতিপূর্বে বহুবার আপনাদিগকে বলিয়াছি এবং প্রতিশ্রুতি দিয়াছি যে যখন আমাদের আকাঙ্ক্ষিত শুভ মুহূর্ত উপস্থিত হইবে, তখন আমি এবং আমার সঙ্গে আরও অনেকে আপনাদিগের পাশে আসিয়া দাঁড়াইবে। আমরা সকলে তখন একইসঙ্গে লড়িব এবং দুঃখভোগ করিব; এবং তারপর একইসঙ্গে আমরা সাফল্য ও স্বাধীনতার গৌরব অর্জন করিব।

 আজ আমি ভারতের সীমান্ত হইতে বেশি দূরে নই। আপনারা জানেন যে ১৯৪১ সালের জানুয়ারি মাস হইতে আজ পর্যন্ত আমার গতিবিধি কেহ রোধ করিতে পারে নাই। অতএব আমি যেদিন ভারতের সীমান্ত পুনরায় অতিক্রম করিয়া দেশে ফিরিব এবং স্বাধীনতা-সংগ্রামের শেষ অধ্যায়ে যোগদান করিব, সেদিনও কোন পার্থিব শক্তি আমার পথ রোধ করিতে পারিবে না।

 স্বদেশবাসী বন্ধুগণ, পরিশেষে যে সব সাথী আজ অন্তরীণের অথবা কারাবাসের লাঞ্ছনা ও নির্যাতন ভোগ করিতেছেন, আপনাদের মারফত দিয়া আমি তাঁহাদের নিকট আমার সাদর অভিনন্দন ও প্রীতিপূর্ণ শুভ ইচ্ছা প্রেরণ করিতে চাই। তাঁহারা যেন মনের উৎসাহ, আনন্দ, স্ফূর্তি না হারান, তাঁহাদের গিয়া বলুন যে মাতৃভূমির সম্মান ও মর্যাদা তাঁহারাই রক্ষা করিয়াছেন। তাঁহাদের লাঞ্ছনা ও নির্যাতন পৃথিবীকে জানাইয়া দিয়াছে যে পরাধীন ভারতবাসী আজ ইংরাজের সহিত সংগ্রামে নিরত। আমরা যাহারা আজ ভারতের বাহিরে কাজ করিতেছি, আমরা তাঁহাদের গর্বে গর্বিত। প্রতিদিন তাঁহাদের কথা আমরা চিন্তা করি এবং তাঁহাদের উদ্দেশ্যে প্রীতি ও শ্রদ্ধার অঞ্জলি নিবেদন করি। আবার তাঁহাদের নিকট গিয়া বলুন যে তাঁহাদের এই বিরাট দুঃখ ও ত্যাগ কখনও ব্যর্থ হইতে পারে না। ভারত পুনরায় স্বাধীন হইবেই হইবে। এবং স্বাধীনতার সূর্য উদয়ের খুব বেশি বিলম্বও নাই। স্বাধীন ভারতে সকল কারাগারের লৌহকবাট উন্মুক্ত হইবে এবং ভারতমাতার শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা তখন কারাপ্রকোষ্ঠের অন্ধকার হইতে মুক্তি ও আনন্দের নির্মল আলোকে বাহির হইয়া জয়মাল্যে ভূষিত হইবেন।

 ইনকিলাব জিন্দাবাদ! আজাদ হিন্দ জিন্দাবাদ!