পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/১০০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

স্বামীকে নাকেশ্বরীর হাত হইতে রক্ষা করিতে যত্ন করিব,— নিশ্চিন্ত হইয়া থাকিব না। হই না কেন স্ত্রীলোক? আমি কি মানুষ নই? পতির হিতকামনায়, আমি সমুদয় জগৎকে তৃণজ্ঞান করি,— কাহাকেও আমি ভয় করি না।”

 মনে মনে এইরূপ কল্পনা করিয়া কঙ্কাবতী চক্ষু মুছিলেন, উঠিয়া বসিলেন। এখন লোকালয়ে যাইতে হইবে, এই উদেশে উঠিয়া দাঁড়াইলেন।

 কিন্তু লোকালয় কোন দিকে, তাহা তো তিনি জানেন না! উত্তরমুখে যাইতে খেতু বলিয়াছিলেন, কিন্তু উত্তর কোন দিক? বিস্তীর্ণ তমোময় সেই বনকান্তারে দিক নির্ণয় করা তো সহজ কথা নহে! রাত্রি এখনও প্রভাত হয় নাই, সূর্য এখনও উদয় হন নাই; তবে কোন দিক উত্তর, কোন দিক দক্ষিণ, কিরূপে তিনি জানিবেন?

 তাই তিনি ভাবিলেন— “যেদিকে হয় যাই। একটা না একটা গ্রামে গিয়া উপস্থিত হইব। লোকালয়ে গিয়া সুচিকিৎসকের অনুসন্ধান করিব। কালবিলম্ব করা উচিত নয়। কালবিলম্ব করিলে আমার আশা হয়তো ফলবতী হইবে না।”

 বন-জঙ্গল, গিরি-গুহা অতিক্রম করিয়া উন্মাদিনীর ন্যায় কঙ্কাবতী চলিলেন। কত পথ যাইলেন, কতদূর চলিয়া গেলেন, কিন্তু গ্রাম দেখিতে পাইলেন না। রাত্রি প্রভাত হইল, সূর্য্য উদয় হইলেন, দিন বাড়িতে লাগিল, তবুও জনমানবের সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হইল না।

 “কি করি, কোন দিকে যাই, কাহাকে জিজ্ঞাসা করি” কঙ্কাবতী এইরূপ চিন্তা করিতেছেন, এমন সময় সম্মুখে একটি ব্যাঙ দেখিতে পাইলেন। ব্যাঙের অপূর্ব্ব মূর্ত্তি। সেই অপূর্ব্ব মূর্ত্তি দেখিয়া কঙ্কাবতী বিস্মিত হইলেন। ব্যাঙের মাথায় হ্যাট, গায়ে কোট, কোমরে পেণ্টুলেন, ব্যাঙ সাহেবের পোষাক পরিয়াছেন। ব্যাঙকে আর চেনা যায় না। রংটি কেবল ব্যাঙের মত আছে, সাবাং মাখিয়াও রংটি সাহেবের মত হয় নাই। আর পায়ে জুতা এখনও কেনা হয় নাই। ইহার পর তখন কিনিয়া পরিবেন। আপাততঃ সাহেবের সাজ সাজিয়া দুই পকেটে হাত রাখিয়া, সদৰ্পে ব্যাঙ চলিয়া যাইতেছেন।

 এই অপূর্ব্ব মূর্ত্তি দেখিয়া, এই ঘোঁর দুঃখের সময়ও কঙ্কাবতীর মুখে ঈষৎ একটু হাসি দেখা দিল। কঙ্কাবতী মনে করিলেন,— ইঁহাকে আমি পথ জিজ্ঞাসা করি।

 কঙ্কাবতী জিজ্ঞাসা করিলেন,— “ব্যাঙ মহাশয়! গ্রাম কোন দিকে? কোন দিক দিয়া যাইলে লোকালয়ে পৌঁছিব?”

 ব্যাঙ উত্তর করিলেন,— “হিট্‌ মিট্‌ ফ্যাট্‌।”

 কঙ্কাবতী বলিলেন,— “ব্যাঙ মহাশয়! আপনি কি বলিলেন, তাহা আমি বুঝিতে পারিলাম না। ভাল করিয়া বলুন। আমি জিজ্ঞাসা করিতেছি— কোন দিক দিয়া যাইলে গ্রামে গিয়া উপস্থিত হইতে পারা যায়?”

 ব্যাঙ বলিলেন,— “হিশ ফিশ ড্যাম।”

 কঙ্কাবতী বলিলেন,— “ব্যাঙ মহাশয়! আমি দেখিতেছি,— আপনি ইংরেজী কথা কহিতেছেন। আমি ইংরেজী পড়ি নাই, আপনি কি বলিতেছেন, তাহা আমি বুঝিতে পারিতেছি না, অনুগ্রহ করিয়া যদি বাঙ্গালা করিয়া বলেন, তাহা হইলে আমি বুঝিতে পারি।”

 ব্যাঙ এদিক-ওদিক চাহিয়া দেখিলেন। দেখিলেন যে, কেহ কোথাও নাই। কারণ, লোকে যদি শুনে যে, তিনি বাঙ্গালা কথা কহিয়াছেন, তাহা হইলে তাহার জাতি যাইবে, সকলে তাহাকে “নেটিভ” মনে করিবে। যখন দেখিলেন,— কেহ কোথাও নাই, তখন বাঙ্গালা কথা বলিতে তাহার সাহসী হইল।

৮৮
ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ