পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/১০২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 কঙ্কাবতী তাঁহাকে ‘সাহেব' বলিলেন, কঙ্কাবতী তাহাকে মিষ্টার গামিশ’ বলিয়া ডাকিলেন, সেজন্য ব্যাঙের শরীর শীতল হইল, রাগ একেবারে পড়িয়া গেল।

 কঙ্কাবতীর প্রতি হৃষ্ট হইয়া ব্যাঙ জিজ্ঞাসা করিলেন,— “আমি সাহেব হইয়াছি কেন তা জান?

 কঙ্কাবতী উত্তর করিলেন,— “আজ্ঞা না! তা আমি জানি না। মহাশয়! গ্রামে কোন দিক দিয়া যাইতে হয়? গ্রাম এখান হইতে কতদূর?”

 ব্যাঙ বলিলেন,— “দেখ লঙ্কাবতী! তোমার নাম লঙ্কাবতী বলিলে বুঝি? দেখ লঙ্কাবতী! একদিন আমি এই বনের ভিতর বসিয়াছিলাম। হাতী সেই পথ দিয়া আসিতেছিল। আমি মনে করিলাম আমার মান-মর্য্যাদা রাখিয়া, অনেক ভয় করিয়া, হাতী অবশ্যই পাশ দিয়া যাইবে। একবার আম্পর্দ্ধার কথা শুন! দুই হাতী পাশ দিয়া না গিয়া আমাকে ডিঙাইয়া গেল। রাগে আমার সর্ব্বশরীর কাপিতে লাগিল। রাগ হইলে আমার আর জ্ঞান থাকে না। আমার ভয়ে তাই সবাই সদাই সশঙ্কিত। আমি ভাবিলাম, হাতীকে একবার উত্তমরূপে শিক্ষা দিতে হইবে। তাই আমি হাতীকে বলিলাম,— ‘উটকপালী চিরুণ-দাঁতী বড় যে ডিঙুলি মোরে?” কেমন, বেশ ভাল বলি নাই, লঙ্কাবতী?

 কঙ্কাবতী বলিলেন,— “আমার নাম কঙ্কাবতী; ‘লঙ্কাবতী’ নয়। আপনি উত্তম বলিয়াছেন। গ্রামে যাইবার পথ আপনি বলিয়া দিলেন না? তবে আমি যাই, আর আমি এখানে অপেক্ষা করিতে পারি না।”

 ব্যাঙ বলিলেন,— “শুন না। অত তাড়াতাড়ি কর কেন? দুষ্ট হাতীর একবার কথা শুন। আমি রাগিয়াছি দেখিয়া তাহার প্রাণে ভয় হইল না। হাতীটি উত্তর করিল,— ‘থাক থাক থাক থ্যাবড়ানাকী ধর্ম্মে রেখেছে তোরে! হাঁ কঙ্কাবতী! আমার কি থ্যাবড়া নাক?”

 কঙ্কাবতী ভাবিলেন যে, এই নাক লইয়া কাঁকড়ার অভিমান হইয়াছিল, আবার দেখিতেছি এই ভেকটিরও সেই অভিমান।

 কঙ্কাবতী বলিলেন,— “না, না। কে বলে আপনার থ্যাবড়া নাক? আপনার চমৎকার নাক! মহাশয়! এই দিক্‌ দিয়া কি গ্রামে যাইতে হয়?

 কিছুক্ষণের নিমিত্ত ব্যাঙ একটু চিন্তায় মগ্ন হইলেন। কঙ্কাবতী মনে করিলেন, ভাবিয়া-চিত্তিয়া ইনি আমাকে পথ বলিয়া দিবেন। কখন পথ বলিয়া দেন, সেই প্রতীক্ষায় একাগ্রচিত্তে কঙ্কাবতী ব্যাঙের মুখপানে চাহিয়া রহিলেন।

 স্থির-গম্ভীরভাবে অনেকক্ষণ চিন্তা করিয়া অবশেষে ব্যাঙ বলিলেন,— “তবে বোধ হয় কথার মিল করিবার নিমিত্ত হাতী আমাকে 'থ্যাবড়ানাকী' বলিয়াছে। কারণ, এই দেখ না? আমার কথায় আর হাতী কথায় মিল হয়,—

 উটকপালী চিরুণ-দাতী বড় যে ডিভুলি মোরে!
 থাক থাক থাক থ্যাবড়ানাকী ধর্ম্মে রেখেছে তোরে?

 কঙ্কাবতী! কবিতাটি খবরের কাগজে ছাপাইলে হয় না? কিন্তু ইহাতে আমার নিন্দা আছে থ্যাবড়া নাকের কথা আছে। তাই খবরের কাগজে ছাপাইব।

 শুনলে তো এখন? হাতীর একবার আস্পর্দ্ধার কথাতাই আমি ভাবিলাম, সাহেব না হইলে লোকে মান্য করে না। সেইজন্য এই সাহেবের পোষাক পরিয়াছি। কেমন? আমাকে ঠিক সাহেবের মত দেখাইতেছে তো? এখন হইতে আমাকে সকলে সেলাম করিবে, সকলে ভয় করিবে। যখন রেলগাড়ীর তৃতীয় শ্রেণীতে গিয়া চড়িব, তখন সে গাড়ীতে অন্য লোক উঠিবে

l৯০
ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ