পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/১০৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ছাগল, পায়রা, এইসব খায়, আবার সাধ করিয়া তাদের পোষে। এই মানুষের ছানাটাকে পুষিলে, ইহার উপর আমার মায়া পড়িবে। ইহাকে খাইতে তখন আর আমার ইচ্ছা হইবে না।”

 মেজ-মশানী আর একপাশ দিয়া উঁকি মারিয়া বলিলেন,— “দিদি! তোমার এক কথা! মানুষের ছানাটাকে যদি পুষিবে তো যাতে কাজে লাগে, এরূপ করিয়া পুষিয়া রাখ। মানুষে যেরূপ দুধের জন্য গরু পোষে, সেইরূপ করিয়া ইহাকে ঘরে পুষিয়া রাখ। কর্ত্তা কতদূর হইতে রক্ত লইয়া আসেন। আনিতে আনিতে রক্ত বাসি হইয়া যায়। মানুষ একটি ঘরে পোষা থাকিলে, যখন ইচ্ছা হইবে, তখন টাটকা রক্ত খাইতে পাইব।”

 রক্তবতীর মা বলিলেন,— “তোমাদের সব এক কথা। সব তাতেই তোমাদের প্রয়োজন। ছেলেমানুষ, রক্তবতী, মানুষের ছানাটিকে পথে কুড়াইয়া পাইয়াছে; পুষিতে কি খাইতে সে তোমাদিগকে দিবে কেন? ছেলের হাতের জিনিসটি তোমরা কাড়িয়া লইতে চাও! তোদের কিরূপ বিবেচনা বল দেখি? আসুন, আজ কর্ত্তা আসুন, তাহাকে সকল কথা বলিব। এ সংসারে আর আমি থাকিতে চাই না। আমাকে তিনি বাপের বাড়ী পাঠাইয়া দিন। আমার বাপ-ভাই বঁচিয়া থাকুক, আমার ভাবনা কিসের? আমি ছন্নছাড়া আটকুড়োদের মেয়ে নই। আমার চারিদিকে সব জাজ্জ্বল্যমান।”

 বড়-মশানী বলিলেন,— “আঃ, মর, ছুড়ির কথা শুন! বাপ-ভাইয়ের গরবে ওঁর মাটিতে পা পড়ে না। বাপ-ভাইয়ের মাথা খাও!”

 এইরূপে তিন পত্নীতে ধুন্ধুমার ঝগড়া বাধিয়া গেল। কঙ্কাবতী অবাক! কঙ্কাবতী মনে করিলেন,— “ভাল কথা! জীবজন্তুর মত ইহারা আমাকে পুষিতে চায়!"

 তিন সতীনে ঝগড়া ক্রমে একটু থামিল। মশা ঘরে আসিবেন, সেই প্রতীক্ষায় কঙ্কাবতী সেইখানে বসিয়া রহিলেন; অনেক বিলম্ব হইতে লাগিল, তবু মশা ফিরিলেন না।

 কঙ্কাবতী জিজ্ঞাসা করিলেন,— “হাঁ গা! তোমাদের কর্ত্তার এত বিলম্ব হইতেছে কেন?”

 ছোটরাণী বলিলেন,— “বাঁশ কাটছেন, ভার বাঁধছেন, রক্ত নিয়ে আসছেন পারা।”

 অর্থাৎ কিনা, কর্ত্তা হয়তো আজ অনেক রক্ত পাইয়াছেন। একেলা বহিয়া আনিতে পারিতেছেন না। তাই বাঁশ কাটিয়া ভার বাঁধিয়া মুটে করিয়া রক্ত আনিতেছেন। বিলম্ব সেইজন্য হইতেছে!

 কঙ্কাবতী আরও কিছুক্ষণ বসিয়া রহিলেন, তবুও মশা ঘরে ফিরিলেন না! কঙ্কাবতী পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন,— “তোমাদের কর্ত্তা কখন আসিবেন গা? বড় যে বিলম্ব হইতেছে!”

 এবার মধ্যম মশানী উত্তর দিলেন,— “তুষের ধোঁ, কুলোর বাতাস, কোণ নিয়েছেন পারা।”

 অর্থাৎ কিনা— চরিবার নিমিত্ত কর্ত্তা হয়তো কোনও লোকের ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়াছেন। সে লোক তুষের অগ্নি করিয়া তাহার উপর সূর্পের বাতাস দিয়া, ঘর ধূমে পরিপূর্ণ করিয়াছে। কর্ত্তা গিয়া ঘরের এক কোণে লুক্কায়িত হইয়াছেন, বাহির হইতে পারিতেছেন না। সেইজন্য বিলম্ব হইতেছে।—একটু ধুম কমিলে বাহির হইয়া আসিবেন।

 কঙ্কাবতী আবার অনেকক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া রহিলেন। তাহার পর পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন,— “কৈ গা। তিনি তো এখনও এলেন না! আর কত বিলম্ব হইবে?”

 এইবার বড়-মশানী উত্তর করিলেন,— “কটাস্ কামড়, চটাসচাপড়, মরে গিয়েছেন পারা।”

 অর্থাৎ কিনা,— কর্ত্তা হয়তো কোনও লোকের গায়ে বসিয়াছিলেন। গায়ে বসিয়া যেমন কটাস করিয়া কামড় মারিয়াছেন, আর আমনি সে লোকটি একটি চটাস করিয়া চাপড়

কঙ্কাবতী
৯৫