পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/১৩১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 এই কথা শুনিয়া চাঁদের ভয় হইল। চাঁদ বলিলেন,— “আমার মূল-শিকড়ে ব্যথা হইয়াছে, আমি এখন গড়াইতে পারিব না, ততদূর আমি যাইতে পারিব না।”

 কঙ্কাবতী বলিলেন,— “তার ভাবনা কি? আমি তোমাকে কাপড়ে বঁধিয়া লইয়া যাইব।”

 চাঁদের প্রাণ উড়িয়া গেল! চাঁদ ভাবিলেন,— “যা ভয় করিয়াছিলাম তাই! কেন মরিতে ইহার সহিত কথা কহিয়াছিলাম! চক্ষু বুজিয়া, চুপ করিয়া থাকিলেই হইত।”

 চাঁদ বলিলেন,— “আমার দাঁতের গোড়া ভাল হইয়া গিয়াছে, আর ব্যথা নাই। সেজন্য তোমাকে আর কষ্ট করিতে হইবে না, আমি বড় ভারি, আমাকে তুমি লইয়া যাইতে পরিবে না। এখন যাও। বিলম্ব করিলে তোমার বাড়ীর লোকে ভাবিবে।”

 কঙ্কাবতী উত্তর করিলেন,— “কি বলিলে? তুমি ভারি! বাপের বাড়ী থাকিতে তোমার চেয়ে বড় বড় বগী-থাল আমি ঘাটে লইয়া মাজিতাম। এই দেখ, তোমাকে লইয়া যাইতে পারি কি না।”

 এই কথা বলিয়া কঙ্কাবতী আকাশের উপর আঁচলটি পাতিলেন! চাঁদটিকে ধরিয়া আঁচলে বাঁধেন আর কি! এমন সময় চাঁদের স্ত্রী চাঁদের ছানা-পোনা লইয়া উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিতে কাঁদিতে আছাড়িপিছড়ি খাইতে খাইতে, সেইখানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। চাঁদনীর কান্নায় আকাশ ফাটিয়া যাইতে লাগিল। চাঁদের ছানা-পোনার কান্নায় কঙ্কাবতীর কানে তালা লাগিল।

 চাঁদনী কাঁপিতে লাগিলেন,— “ওগো আমি দুর্দ্দান্ত সিপাহীর মুখে শুনিলাম যে, মানুষে তোমার মূল-শিকড় কাটিবে; ওগো, আমি সে পোড়ারমুখী মানুষীর কি বুকে ধান ভানিয়াছি যে, সে আমার সহিত এরূপ শত্রুতা সাধিবে। আমাকে যদি বিধবা হইতে হয়, তাহা হইলে তারও আমার মত হাত হইবে। সে বাপ-ভাইয়ের মাথা খাইবে।

 চাঁদের ছানা-পোনাগুলি কঙ্কাবতীর কাপড় ধরিয়া টানিতে লাগিল, আর বলিতে লাগিলেন,— “ওগো, তোমার পায়ে পড়ি। বাবার তুমি মূল-শিকড় কাটিও না, বাবাকে ধরিয়া লইয়া যাইও না।”

 চাঁদের ছোটমেয়েটি—যেটি পাথুরে পোকার টিপের মত, সেই মেয়েটি মাঝে মাঝে কাঁদে, মাঝে মাঝ রাগে, আর কঙ্কাবতীকে গালি দিয়া বলে,— “অভাগী, পোড়ারমুখী, শালা!” আবার সে কঙ্কাবতীকে গায়ের চারিদিকে কঙ্কাবতী ব্যতিব্যস্ত হইয়া পড়িলেন।

 কঙ্কাবতী বলিলেন,— “ওগো! ও চাঁদনী! তোমার মেয়ে সামলাও বাছা; তোমার এ ছোটমেয়েটি চিমটি কাটিয়া আমার গায়ের ছাল-চামড়া তুলিয়া লইতেছে!”

 চাঁদনী উত্তর করিলেন,— “হাঁ, মেয়ে সামলাবো বৈ কি? তুমি আমার সর্বনাশ করিবে, আর আমি মেয়ে সামলাবো। কেন, বাছা? তোমার আমি কি করিয়াছি যে, তুমি আমার সর্ব্বনাশ করিবে? মূল-শিকড়টি কাটিয়া তুমি আমার পতির প্রাণবধ করিবে?”

 কঙ্কাবতী বলিলেন,— “না গো না! আমি তোমার পতির প্রাণবধ করি নাই। একটুখানি শিকড়ের আমার আবশ্যক ছিল, তা আমি উপর উপর চাঁচিয়া লইয়াছি। অধিক রক্তও পড়ে নাই, কিছুই হয় নাই। তুমি বরং চাঁদকে জিজ্ঞাসা করিয়া দেখ? তারপর, তোমার স্বামী বলিলেন যে, তার দাঁত নড়িতেছে। তাই মনে করিলাম যে, কলিকাতায় লইয়া যাই, দাঁত ভাল করিয়া পুনরায় তোমার স্বামীকে আকাশে পাঠাইয়া দিব। তাতে আর কাজ নাই বাছা, এখন তোমরা সব চুপ কর। আর তোমার এই মেয়েটিকে বল, আমায় যেন আর চিমটি না কাটে।”

 এই কথা শুনিয়া চাঁদনী আশ্বস্ত হইলেন। চাঁদের ছেলেপিলেদেরও কান্না থামিল। চাঁদনী বলিলেন,— “তোমার যদি বাছা, কাজ সারা হইয়া থাকে, তবে তুমি এখন বাড়ী যাও। তোমার ভয়ে, আকাশ একেবারে লণ্ডভণ্ড হইয়া গিয়াছে। আকাশবাসীরা সব ঘরে খিল

কঙ্কাবতী
১১৯