পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/১৬৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

নয়। আজ আমার মনে যে শেল মারিলে, তাহার কাছে সে কষ্ট কি ছার! সকলই অদৃষ্টের দোষ। যাও, হিরণ্ময়ী ঘরে যাও। নিধিরাম কুরূপ, কদাকার বাঙ্গাল বটে, কিন্তু অভদ্র নয়। তুমি যাহাতে সুখী হও, তাহা আমি করিব।”

 তাহার পরদিন নিধিরাম নবীনের মাতুলের সহিত সাক্ষাৎ করিলেন। নবীনের পিতা-মাতা হিরণ্ময়ীর সহিত বিবাহে সম্মত আছেন, তাহা জানিতে পারিলেন। নিধিরাম বলিলেন,— “আপনারা অধিক আড়ম্বর করিবেন না। কেবল বর, পুরোহিত ও নাপিত লইয়া আসিবেন। এই মাসেই হিরণ্ময়ীর সহিত নবীনের বিবাহ হইবে। আমি যেমন করিয়া পারি, হিরণ্ময়ীর পিতাকে সম্মত করিব।” নবীনের মাতুল এ কথায় সম্মত হইলেন।

 তাহার পর নিধিরাম এককড়িকে বলিলেন,— “মহাশয়! আমার এই বিকট মূর্ত্তি দেখিয়া ভূত পর্যন্ত ভয়ে পলায়। নিজের মুখ নিজে দেখিয়া আমি ভয় পাই। আমি হিরণ্ময়ীকে কখনই বিবাহ করিব না, ইহা আমার একান্ত প্রতিজ্ঞা জানিবেন। হিরণ্ময়ীর সহিত নবীনের বিবাহ হইবে, সব স্থির হইয়াছে। এখন আপনি অনুমতি করিলেই হয়।”

 এককড়ি কিছুতেই সম্মত হইলেন না। তিনি বলিলেন,— “আমার কন্যা কুলটা নহে। কন্যা আমি আপনাকে সমৰ্পণ করিয়াছি। কন্যা আমার আপনার পত্নী। অন্যমত করিলে আমি ধর্ম্মে পতিত হইব, কন্যাও ধর্ম্মে পতিত হইবে। এ কাজ করিতে আমি কিছুতেই পারিব না।”

 নিধিরাম এককড়িকে ক্রমাগত জপাইতে লাগিলেন। কত বলিলেন, কত বুঝাইলেন, কিন্তু এককড়ি কিছুতেই সম্মত হইলেন না। অবশেষে নিতান্ত বিরক্ত হইয়া এককড়ি বলিলেন,— “ভূমি ও গৃহিণী যাহা জান, কর; আমি বাটী হইতে চলিলাম। এ পাপে আমি লিপ্ত থাকিব না।” এই বলিয়া এককড়ি বাটী হইতে প্রস্থান করিলেন।

 নিধিরামের হাতে অবশিষ্ট টাকা ছিল, তাহা দিয়া বিবাহের সমুদয় আয়োজন করিলেন। বিবাহের দিন উপস্থিত হইল। একজন জ্ঞাতি ডাকিয়া নিধিরাম কন্যা উৎসর্গ করাইলেন। নবীনের সহিত হিরণ্ময়ীর বিবাহ-কার্য্য সমাধা হইল।

 অনেক অনুসন্ধান করিয়া, নিধিরাম তাহার পরদিন এককড়িকে বাহির করিলেন। নিকটস্থ একটি গ্রামে, আহার নিদ্রা পরিত্যাগ করিয়া শোকে, দুঃখে আকুল হইয়া তিনি পড়িয়াছিলেন।

 নিধিরাম বলিলেন,— “মহাশয়! কার্য্য শেষ হইয়া গিয়াছে। কন্যা লইয়া আপনার জামাতা নবীন, আজ নিজ গ্রামে গমন করিবেন,— কন্যা বিদায় করিবেন চলুন।”

 এককড়ি উত্তর করিলেন,— “নিধিরাম! তোমা হেন দেব-পুরুষকে যে জামাতা করিতে পরিলাম না, পুত্র বলিয়া সম্বোধন করিতে পারিলাম না, সে দুঃখ বড় রহিল। বৃদ্ধ হইয়াছি, অধিক দিন আর বাঁচিব না, কিন্তু এই মনের কালি আর কখনও ঘুঁচিবে না। চল যাই, চিরদিনের নিমিত্ত হিরণ্ময়ীকে বিদায় করি। কি জন্য তুমি তাহাকে বিবাহ করিলে না, তাহা জানি না, কিন্তু আর আমি কখনও তাহার মুখ দেখিব না।”

 দশ ক্রোশদূর, জয়দেবপুর যাইবেন বলিয়া, নবীন নৌকা ভাড়া করিলেন। হিরণ্ময়ীকে লইয়া উঠিলেন। তাহাদিগকে বিদায় করিবার নিমিত্ত এককড়ি ও নিধিরাম গঙ্গার ঘাট পর্যন্ত আসিয়াছিলেন। নৌকা ছাড়িয়া দিল।

 নিধিরাম এককড়িকে বলিলেন,— “মহাশয়! আমার বুকের ভিতর কিরূপ করিতেছে। মা’র সুশীতল পবিত্র নীরে শরীরে কিয়দংশ কিছু কালের নিমিত্ত নিমগ্ন করিয়া রাখি, তাহা হইলে বোধ হয় শরীর সুস্থ হইবে। আপনি আমার নিকটে বসুন, আপনার কোলে মাথা রাখিয়া একটু বিশ্রাম করি।”

ভূত ও মানুষ
১৫৩