পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/২৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

নিরঞ্জন

তনু রায়ের সহিত নিরঞ্জন কবিরত্নের ভাব নাই। নিরঞ্জন তনু রায়ের প্রতিবেশী।

 নিরঞ্জন বলেন, — “রায় মহাশয়! কন্যার বিবাহ দিয়া টাকা লইবেন না, টাকা লইলে ঘোর পাপ হয়।”

 তনু রায় তাই নিরঞ্জনকে দেখিতে পারেন না, নিরঞ্জনকে তিনি ঘৃণা করেন। যেদিন তনু রায়ের কন্যার বিবাহ হয়, নিরঞ্জন সেই দিন গ্রাম পরিত্যাগ করিয়া অপর গ্রামে গমন করেন। তিনি বলেন,— “কন্যা বিক্রয় চক্ষে দেখিলে, কি সে কথা কর্ণে শুনিলেও পাপ হয়।”

 নিরঞ্জন অতি পণ্ডিত লোক! নানা শাস্ত্র তিনি অধ্যয়ন করিয়াছেন। বিদ্যা-শিক্ষার শেষ নাই, তাই রাত্রি-দিন তিনি পুঁথি-পুস্তক লইয়া থাকেন। লোকের কাছে আপনার বিদ্যার পরিচয় দিতে ইনি ভালবাসেন না। তাই জগৎ জুড়িয়া ইহার নাম হয় নাই। পূর্ব্বে অনেকগুলি ছাত্র ইহার নিকট বিদ্যাশিক্ষা করিত। দিবারাত্রি তাহাদিগকে বিদ্যা-শিক্ষা দিয়া, ইনি পরম পরিতোষ লাভ করিতেন। আহার-পরিচ্ছদ দিয়া ছাত্রগুলিকে পুত্রের মত প্রতিপালন করিতেন। লোকের বাড়ী নিমন্ত্রণে গিয়া বিদায়ের জন্য ইনি মারামারি করিতেন না। কারণ, ইহার অবস্থা ভাল ছিল। পৈতৃক অনেক ব্রহ্মোত্তর ভূমি ছিল।

 গ্রামের জমিদার, জনার্দ্দন চৌধুরীর সহিত এই ভূমি লইয়া কিছু গোলমাল হয়। একদিন দুই প্রহরের সময় জমিদার একজন পেয়াদা পাঠাইয়া দেন।

 পেয়াদা আসিয়া নিরঞ্জনকে বলে,— “ঠাকুর! চৌধুরী মহাশয় তোমাকে ডাকিতেছেন, চল!"

 নিরঞ্জন বলিলেন, “আমার আহার প্রস্তুত, আমি আহার করিতে যাইতেছি। আহার হইলে জমিদার মহাশয়ের নিকট যাইব। তুমি এক্ষণে যাও।”

 পেয়াদা বলিল,— “তাহা হইবে না, এইক্ষণেই আমার সহিত যাইতে হইবে।”

 নিরঞ্জন বলিলেন, — “বেলা দুইপ্রহর অতীত হইয়া গিয়াছে, ঠাঁই হইয়াছে, ভাত প্রস্তুত, ভাত দুইটি মুখে দিয়া, চল, যাইতেছি। কারণ, আমি আহার না করিলে গৃহিণী আহার করবেন না, ছাত্রগণেরও আহার হইবে না। সকলেই উপবাসী থাকিবে।”

 পেয়াদা বলিল,— “তাহা হইবে না, তোমাকে এইক্ষণেই যাইতে হইবে।”

 নিরঞ্জন বলিলেন,— “এইক্ষণেই যাইতে হইবে, বটে? আচ্ছা, তবে চল যাই।”

 পেয়াদার সহিত নিরঞ্জন দিয়া জমিদারের বাটীতে উপস্থিত হইলেন।

 জনার্দ্দন চৌধুরী বলিলেন,— “কখন আপনাকে ডাকিতে পাঠাইয়াছি, আপনার যে আর আসিবার বার হয় না!”

 নিরঞ্জন বলিলেন, — “আজ্ঞা, হাঁ মহাশয়! আমার একটু বিলম্ব হইয়াছে।”

 জমিদার বলিলেন, — “বামুনমারীর মাঠে আপনার যে পঞ্চাশ বিঘা ব্রহ্মোত্তর ভূমি আছে, জরিপে তাহা পঞ্চান্ন বিঘা হইয়াছে। আপনার দলিল পত্র ভাল আছে, সে জন্য সবটুকু ভূমি আমি কাড়িয়া লইতে বাসনা করি না, তবে মাপে যেটুকু অধিক হইয়াছে, সেটুকু আমার প্রাপ্য।”

 নিরঞ্জন উত্তর করিলেন,— “আজ্ঞা, হাঁ মহাশয় দলিল পত্র আমার ভাল আছে। দেখুন দেখি এই কাগজখানি কি না?”

কঙ্কাবতী
১১