পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/৩১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 খেতুকে তিনি একদিন জিজ্ঞাসা করিলেন,— “খেতু! তুমি জল খাও না কেন? পয়সা লইয়া কি কর?”

 খেতু কিছু অপ্রতিভ হইলেন, একটুখানি চুপ করিয়া উত্তর করিলেন,— “দাদামহাশয়! যেদিন বড় ক্ষুধা পায়, যেদিন আর থাকিতে পারি না, সেই দিন জল খাই; যেদিন না খাইয়া থাকিতে পারি, সেইদিন আর খাই না। যা পয়সা বাঁচিয়াছে, তাহা আমার কাছে আছে। যখন মার নিকট হইতে আসি, তখন মাকে বলিয়াছিলাম যে, মা! তোমার জন্য আমি একছড়া মালা কিনিয়া আনিব; সেইজন্য এই পয়সা রাখিতেছি।”

 যখন এই কথা হইতেছিল, তখন রামহরির নিকট খেতু দাঁড়াইয়াছিলেন। রামহরি খেতুর মাথায় হাত দিয়া সম্মুখের চুলগুলি পশ্চাৎদিকে ফিরাইতে লাগিলেন। খেতু বুঝিলেন, দাদা রাগ করেন নাই, আদর করিতেছেন।

 কিয়ৎক্ষণ পরে রামহরি বলিলেন,— “খেতু! যখন মালা কিনিবে আমাকে বলিও, আমি ভাল মালা কিনিয়া দিব।”

 পূজার ছুটি নিকট হইল। তখন খেতু বলিলেন,— “দাদা মহাশয়! কৈ, এইবার মালা কিনিয়া দিন?”

 রামহরি বলিলেন,— “তোমার কতগুলি পয়সা হইয়াছে, নিয়ে এস, দেখি?”

 খেতু পয়সাগুলি আনিয়া দাদার হাতে দিলেন। রামহরি গণিয়া দেখিলেন যে, এক টাকারও অধিক পয়সা হইয়াছে। আট আনা দিয়া রামহরি একছড়া ভাল রুদ্রাক্ষের মালা কিনিয়া, বাকি পয়সাগুলি খেতুকে ফিরাইয়া দিলেন।

 খেতু বলিলেন,— “দাদা মহাশয়! আমি এ পয়সা লইয়া আর কি করিব? এ পয়সা আপনি নিন।”

 রামহরি উত্তর করিলেন,— “না খেতু।মাকে দিও, তোমার মা কত আহ্লাদ করিবেন।”

 বাড়ী যাইবার দিন নিকট হইল। এখানে খেতুর মনে, আর সেখানে মার মনে আনন্দ আর ধরে না। তসর ও গালার ব্যবসায়ীর সকলে এখন দেশে যাইতেছিলেন। তাহাদের সহিত রামহরি খেতুকে পাঠাইয়া দিলেন, আর কবে কোন সময়ে দেশে পৌঁছিবেন, সে সমাচার আগে থাকিতে খেতুর মাকে লিখিলেন।

 দত্তদের পুকুরধারে কেন? খেতুর মা আরও অনেক দূরে গিয়া দাঁড়াইয়াছিলেন। দূর হইতে খেতু মাকে দেখিতে পাইয়া ছুটিয়া গিয়া তাঁহাকে ধরিলেন। খেতুর মা, ছেলেকে বুকে করিয়া স্বর্গসুখ লাভ করিলেন।

 খেতু বলিলেন,— “ঐ যা! মা! আমি তোমাকে প্রণাম করিতে ভুলিয়া গিয়াছি।”

 মা উত্তর করিলেন,— “থাক, আর প্রণামে কাজ নাই। অমনি তোমাকে আশীর্ব্বাদ করি, তুমি চিরজীবী হও, তোমার সোনার দোয়াত-কলম হউক।”

 খেতু বলিলেন,— ‘মা! আমি মনে করিয়াছিলাম, তুমি দত্তদের পুকুরধারে থাকিবে, এত দূরে আসিবে, তা’ জানিতাম না!”

 মা বলিলেন,— “বাছা! যদি উপায় থাকিত, তো আমি কলিকাতা পর্য্যন্ত যাইতাম। খেতু! তুমি রোগী হইয়া গিয়োছ।”

 খেতু উত্তর করিলেন,— “না মা! রোগা হই নাই, পথে একটু কষ্ট হইয়াছে, তাই রোগা-রোগা দেখাইতেছে। মা! এখন আমি হাঁটিয়া যাই, এতদূর তুমি আমাকে লইয়া যাইতে পরিবে না।”

কঙ্কাবতী
১৯