পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/৩৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 রামহরির সংসারে খেতু সহায়তা করিতে লাগিলেন বটে, কিন্তু রামহরি এ কথায় সহজে স্বীকার হন নাই। একবার খেতু নরহরির জন্য একজোড়া কাপড় কিনিয়াছিলেন। তাহা জানিতে পারিয়া রামহরি খেতুকে বকিয়াছিলেন। খেতুর তাঁহাতে অতিশয় অভিমান হইয়াছিল। দাদাকে কিছু না বলিয়া তিনি রামহরির স্ত্রীর নিকট গিয়া নানারূপ দুঃখ করিতে লাগিলেন। রামহরির স্ত্রীকে খেতু বৌ-দিদি বলিয়া ডাকিতেন।

 খেতুর অভিমান দেখিয়া বৌ-দিদি বলিলেন,— “তোমার দাদাকে কিছু বলিতে না পারিয়া, তুমি বুঝি আমার সঙ্গে ঝগড়া করিতে আসিয়াছ?”

 খেতু উত্তর করিলেন,— “বৌ-দিদি। তোমরা আমাকে প্রতিপালন করিয়াছ। তোমাদের পুত্র নরহরি যেরূপ, আমাকেও সেইরূপ দেখা উচিত। পুত্রের মত আমাকে যখন না দেখিলে, তখন আমি পর। আমি যখন পর, তখন আবার তোমাদের সঙ্গে আমার ঝগড়া কি? দাদা মহাশয় আমাকে পর মনে করিয়াছেন, এখন তুমিও তাই কর, তাহা হইলে সকল কথাই ফুরাইয়া যায়।”

 বৌ-দিদি বলিলেন,— “তাহা হইলে কি হয়, খেতু?”

 খেতু উত্তর করিলেন,— “কি হয়? হয় আর কি? তাহা হইলে আমি আর অর্থোপাৰ্জ্জন করিতে যত্ন করি না। তোমাদের সহিত আর কথা কই না। তোমাদের বাড়ীতে আর থাকি না। মনে করি, আমার মাকে ভিখারিণী দেখিয়া ইহারা ভিক্ষা দিয়াছিলেন। আমার এই শরীর, আমার এই অস্থি, মাংস সমুদায় ভিক্ষায় গঠিত। ভদ্রসমাজে আর যাই না, ভদ্রসমাজে আর মুখ তুলিয়া কথা কহি না। দুঃখিনী ভিখারিণীর ছেলে, ভিক্ষায় যাহা দেহ গঠিত, কোন মুখে সে আবার ভদ্র সমাজে দাঁড়াইবে?”

 বৌ-দিদি বললেন, “ছি খেতু! অমন বলিতে নাই। সম্পর্কে তুমি দেবর বটে, কিন্তু পুত্রের চেয়ে তোমাকে অধিক স্নেহ করি। তুমি উপযুক্ত সন্তান, তুমি যাহা করিবে, তাঁহাই হইবে; তাহার আবার অভিমান কি?”

 খেতু বলিলেন,— “বৌ-দিদি! মাকে সুখে রাখিব, তোমাদিগকে সুখে রাখিব, চিরকাল আমার এই কামনা। এক্ষণে আমার ক্ষমতা হইয়াছে, এখন যদি তোমরা আমাকে সে কামনা পূর্ণ করিতে না দাও, তাহা হইলে আমার মনে বড় দুঃখ হইবে।”

 বৌ-দিদি উত্তর করিলেন,— “সার্থক তোমার মা তোমাকে গর্ভে ধরিয়াছেন। এখন আশীর্ব্বাদ করি, খেতু! শীঘই তোমার একটি রাঙা বৌ হউক।”

 সেইদিন রামহরির স্ত্রী, রামহরিকে অনেক বুঝাইয়া বলিলেন,— “দেখ! আমাদের সংসারের কষ্ট দেখিয়া খেতু বড় কাতর হইয়াছে। খেতু এখন দু’পয়সা আনিতেছে। সে বলে,— ‘যখন ইহারা আমাকে পুত্রের মত প্রতিপালন করিয়াছেন, তখন আমিও পুত্রের মত কার্য্য করিব।' সংসার-খরচে খেতু যদি কোনরূপ সহায়তা করে, তাহা হইলে খেতুকে কিছু বলিও না। এ বিষয়ে খেতুকে কিছু বলিলে, তাহার মনে বড় দুঃখ হয়।”

 স্ত্রীর কাছে সকল কথা শুনিয়া, রামহরি খেতুকে ডাকিলেন। খেতু আসিলে রামহরি তাঁহাকে বলিলেন,— “রাগ করিয়াছ, দাদা? পৃথিবী অতি ভয়ানক স্থান! আমার মত যখন বয়স হইবে, তখন জানিতে পরিবে যে, টাকা টাকা করিয়া পৃথিবীর লোক কিরূপ পাগল। সেইজন্য, খেতু, তোমাকে আমার সংসারে টাকা খরচ করিতে মানা করিয়াছিলাম। আমাদের দুঃখ চিরকাল। আমাদের কখনও ‘নাই নাই ঘুচিবে না।' সে দুঃখের ভাগী তোমাকে আমি কেন করিব? অনেক দিন হইতে আমি জলখাবার খাই না। জ্বর হইলে উপবাস দিয়া ভাল করি। তুমি দুধের ছেলে,

কঙ্কাবতী
২৫