পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/৫৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 “শুনিলাম, সেদিন কঙ্কাবতী মাকে বলিয়াছেন যে, 'মা। তুমি কাঁদিও না! আমার এই কয়খানা হাড় বেচিয়া বাবা যদি টাকা পান, তাতে দুঃখ কি মা? এরূপ কত হাড় শ্মশানঘাটে পড়িয়া থাকে, তাহার জন্য কেহ একটি পয়সাও দেয় না। আমার এই হাড় ক'খানার যদি অত মূল্য হয়, বাপ-ভাই সেই টাকা পাইয়া যদি সুখী হন, তার জন্য আর আমরা দুঃখ কেন করি মা? তবে মা! আমি বড় দুর্ব্বলল হইয়াছি, শরীরে আমার সুখ নাই। পাছে এই কয়দিনের মধ্যে আমি মরিয়া যাই, সেই ভয় হয়। টাকা না পাইতে পাইতে মরিয়া গেলে, বাবা আমার উপর বড় রাগ করিবেন। আমি তো ছাই হইয়া যাইব, কিন্তু আমাকে তিনি যখনি মনে করিবেন, আর তখনি কত গালি দিবেন।”

 খেতুর মা পুনরায় বলিলেন, — “খেতু কঙ্কাবতীর কথা যা আমি শুনি, তো তোমাকে বলি না, পাছে তুমি অধৈর্য্য হইয়া পড়! কঙ্কাবতীর যেরূপ অবস্থা শুনিতে পাই, কঙ্কাবতী আর অধিক দিন বাঁচিবে না।”

 খেতু বলিলেন,— “মা। আমি তনু রায়কে বলিলাম যে, রায় মহাশয়! আপনাকে আমার সহিত কঙ্কাবতীর বিবাহ দিতে হইবে না, একটি সুপাত্রের সহিত দিন। রামহরি দাদা ও আমি ধনাঢ্য সুপাত্রের অনুসন্ধান করিয়া দিব। কিন্তু মা! তনু রায় আমার কথা শুনিলেন না, অনেক গালি দিয়া আমাকে তাড়াইয়া দিলেন। আমাদের কি মা? আমরা অন্য গ্রামে গিয়া বাস করিব। কিন্তু কঙ্কাবতী যে এখানে চিরদুঃখিনী হইয়া রহিল। সেই মা দুঃখ! আমি কাপুরুষ, যে তাহার কোন উপায় করিতে পারিলাম না, সেই মা দুঃখ। আর মা, যদি কঙ্কাবতীর বিষয়ে কোন কথা শুনিতে পাও, তো আমাকে বলিও। আমার নিকট কোনও কথা গোপন করিও না। আহা! সীতাকে এ সময়ে কলিকাতায় কেন পাঠাইয়া দিলাম। সীতা যদি এখানে থাকিত, তাহা হইলে প্রতিদিনের সঠিক সংবাদ পাইতাম।”

 খেতুর মা, তার পরদিন খেতুকে বলিলেন,— “আজি শুনিলাম, কঙ্কাবতীর বড় জ্বর হইয়াছে। আহা! ভাবিয়া ভাবিয়া জ্বর হইবে, সে আর বিচিত্র কথা কি? বাছার এখন প্রাণরক্ষা হইলে হয়। জনার্দ্দন চৌধুরী কবিরাজ পাঠাইয়াছেন, আর বলিয়া দিয়াছেন যে, যেমন করিয়া হউক, চারিদিনের মধ্যে কঙ্কাবতীকে ভাল করিতে হইবে।”

 খেতু বলিলেন, — “তাই তো মা! এখন কঙ্কাবতীর প্রাণটা রক্ষা হইলে হয়। মা! কঙ্কাবতীর বিড়াল আসিলে এ কয়দিন তাহাকে ভাল করিয়া দুধ-মাছ খাইতে দিবে। হাঁ মা! আমরা এখান হইতে চলিয়া যাইলে, কঙ্কাবতীর বিড়াল কি আমাদের বাড়ীতে আর আসিবে? না, বড় মানুষের বাড়ীতে গিয়া আমাদিগকে ভুলিয়া যাইবে?”

 খেতুর মা কোনও উত্তর দিলেন না, আঁচলে চক্ষু মুছিতে লাগিলেন। এইরূপে দিন দিন কঙ্কাবতীর পীড়া বাড়িতে লাগিল, কিছুই কমিল না। সাত দিন হইল। বিবাহের দিন উপস্থিত হইল।

 সেদিন কঙ্কাবতীর গায়ের বড় জ্বালা, কঙ্কাবতীর বড় পিপাসা, কঙ্কাবতী একেবারে শয্যাধরা। কঙ্কাবতীর সমূহ রোগ। কঙ্কাবতীর ঘোর বিকার। কঙ্কাবতীর জ্ঞান নাই, সংজ্ঞা নাই। লোক চিনিতে পারেন না, কঙ্কাবতী এখন যান। তখন যান!

৪২
ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ