পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/৬৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

চলিলে! চল, মা! যেখানে কঙ্কাবতী, যেখানে তুমি, সেইখানে আমিও শীঘ্র যাইব। এই সসাগরা পৃথিবী আজ আমার পক্ষে শ্মশান-ভূমি হইল। এ সংসারে আর আমার কেহ নাই। চল, মা, শীঘ্রই তোমাদিগের নিকট গিয়া প্রাণের এ দারুণ জ্বালা জুড়াইব। মা! কঙ্কাবতীকে বলিও, শীঘ্রই গিয়া আমি তাহার সহিত মিলিব।”

 কঙ্কাবতী আসিয়া অধোমুখে খেতুর সম্মুখে দাঁড়াইলেন। খেতু চমকিত হইলেন, অন্ধকারে চিনিতে পারিলেন না।

 কঙ্কাবতী মা'র পায়ের নিকট গিয়া বসিলেন। মা'র পা দুখানি আপনার কোলের উপর তুলিয়া লইলেন। সেই পায়ের উপর আপনার মাথা রাখিয়া নীরবে কাঁদিতে লাগিলেন। ঘোরতর বিস্মিত হইয়া, অনেকক্ষণ ধরিয়া, খেতু তাঁহার মুখপানে চাহিয়া রহিলেন। অবশেষে খেতু বলিলেন, —“কঙ্কাবতী! জ্ঞান হইয়া পর্যন্ত এ পৃথিবীতে কখনও কাহারও অনিষ্টচিন্তা করি নাই, সর্ব্বদা সকলের ইষ্টচিন্তাই করিয়াছি। জানিয়া-শুনিয়া কখনও মিথ্যাকথা বলি নাই, প্রবঞ্চনা কখনও করি নাই, কোনওরূপ দুষ্কর্ম্ম কখনও করি নাই। তবে কি মহাপাপের জন্য আজ আমার এ ভীষণ দণ্ড, আজ এ ঘোর নরক! বিনা দোষে কত দুঃখ পাইয়াছি, তাহা সহিয়াছি। গ্রামের লোকে বিধিমত উৎপীড়ন করিলে, তাহাও সহিলাম; প্রাণের পুতলি তুমি কঙ্কাবতী জলে ডুবিয়া মরিলে, তাহাও সহিলাম; প্রাণের অধিক মা আমার আজ মরিলেন, তাহাও সহিলাম; কিন্তু এই সঙ্কটসময়ে তুমি যে আমার শক্রতা সাধিবে, স্বপ্নেও তাহা কখনও ভাবি নাই! মাতার মৃতদেহ একেলা আমি আর বহিতে পারিতেছি না। মাতার পীড়ার জন্য আজ তিন দিন আহার নাই, নিদ্রা নাই। আজ তিন দিন একবিন্দু জল পর্যন্ত আমি খাই নাই। শরীরে আমার শক্তি নাই, শরীর আমার অনুসন্ন হইয়া পড়িয়াছে। আর একটি পা-ও আমি লইয়া যাইতে পারিতেছি না। কি করি, ভাবিয়া আকুল হইয়াছি। এমন সময়ে কি না, তুমি কঙ্কাবতী, ভূত হইয়া আমাকে ভয় দেখাইতে আসিলে! দুঃখের এইবার আমার চারি পো হইল। এ দুঃখ আমি আর সহিতে পারি না।”

 কাঁদ কাঁদ স্বরে অধোমুখে, কঙ্কাবতী উত্তর করিলেন,— “আমি ভূত হই নাই, আমি মরি নাই, আমি জীবিত আছি।”

 আশ্চর্য্য হইয়া খেতু জিজ্ঞাসা করিলেন,— “তুমি জীবিত আছ? জলে ডুবিয়া গেলে, তোমায় আমরা কত অনুসন্ধান করিলাম। তোমাকে খুঁজিয়া পাইলাম না। মনে করিলাম, আমিও মরি। মরিবার নিমিত্ত জলে ঝাঁপ দিলাম। সাঁতার জানিয়াও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হইয়া জলের ভিতর রহিলাম, কিছুতেই উঠিলাম না। তাহার পর জ্ঞানশূন্য হইয়া পড়িলাম। অজ্ঞান অবস্থায় জেলেরা আমাকে তুলিল, তাহারা আমাকে বাঁচাইল। জ্ঞান হইয়া দেখিলাম, মা আমার কাঁদিতেছেন। মা'র মুখপানে চাহিয়া প্রাণ ধরিয়া রহিলাম। কঙ্কাবতী, তুমি কি করিয়া বাঁচিলে?”

 কঙ্কাবতী উত্তর করিলেন,— “সে অনেক কথা। সকল কথা পরে বলিব। আমি গোয়ালিনী মাসীর বাটীতে ছিলাম। এই ঘোর বিপদের কথা সেইখানে শুনিলাম। আমি থাকিতে পারিলাম না, আমি ছুটিয়া আসিলাম। এক্ষণে চল, মাতাকে ঘাটে লইয়া যাই। তুমি একদিক ধর, আমি একদিক ধরি।”

 এই প্রকারে কঙ্কাবতী ও খেতু মাকে ঘাটে লইয়া যাইলেন। সেখানে গিয়া দুই জনে চিতা সাজাইলেন। মাকে উত্তমরূপে স্নান করাইলেন। নূতন কাপড় পরাইলেন। তাহার পর চিতার উপর তুলিলেন। চিতার উপর তুলিয়া দুই জনে মায়ের পা ধরিয়া অনেকক্ষণ কাঁদিলেন।

 খেতু বলিলেন, —“মা! তুমি স্বৰ্গে চলিলে। দীনহীন তোমার এই পুত্রকে আশীর্ব্বাদ কর, ধর্ম্মপথ হইতে যেন কখনও বিচলিত না হই। সত্য যেন আমার ধ্যান, সত্য যেন আমার জ্ঞান, সত্য যেন আমার ক্রিয়া হয়। ধনলালসায়, কি সুখলালসায়, কি যশোলালসায় যেন সত্যপথ,

কঙ্কাবতী
৫৫