পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/৮৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

হয়? আমি বালিকা, আমি অজ্ঞান, আমি জানি না; না জানিয়া এ-কাজ করিয়াছি, ভাল ভাবিয়া মন্দ করিয়াছি। আমার কি আর ক্ষমা নাই!”

 খেতু উত্তর করিলেন,— “কঙ্কাবতী! তোমার উপর আমি রাগ করি নাই। রাগ করিয়া তোমাকে বলি নাই যে, 'তুমি এখান হইতে যাও।' বড় বিপদের কথা, বড় নিদারুণ কথা, কি করিয়া তোমাকে বলি। এখান হইতে তোমাকে যাইতে হইবে, কঙ্কাবতী! নিশ্চয় তোমাকে এখান হইতে যাইতে হইবে, আর এখনি যাইতে হইবে, বিলম্ব করিলে চলিবে না। এখন তুমি পিতার বাটীতে গিয়া থাক, লোকজন সঙ্গে করিয়া দশ দিন পরে পুনর্ব্বার এই বনের ভিতর আসিও। এই অট্টালিকার ভিতর যাহা কিছু ধনসম্পত্তি আছে, তাহা লইয়া যাইও। দশ দিন পরে লইলে কোনও ভয় নাই, তখন তোমাকে কেহ কিছু বলিবে না। এই ধন-সম্পত্তি চারভাগ করিবে। একভাগ তোমার পিতাকে দিবে, একভাগ রামহরি দাদা মহাশয়কে দিবে, একভাগ নিরঞ্জন কাকাকে দিবে, আর একভাগ তুমি লইবে। ব্রতনিয়ম ধর্ম্মকর্ম্ম দানধ্যান করিয়া জীবনযাপন করিবে। মনুষ্য-জীবন কয়দিন? কঙ্কাবতী! দেখিতে দেখিতে কাটিয়া যাইবে। তাহার পর এখন আমি যেখানে যাইতেছি, সেইখানে তুমিও যাইবে; দুইজনে পুনরায় সাক্ষাৎ হইবে।”

 কঙ্কাবতী বলিলেন,— “তোমার কথা শুনিয়া আমার বুক ফাটিয়া যাইতেছে, প্রাণে বড় ভয় হইতেছে।—হায়! আমি কি করিলাম। কি বিপদের কথা? কি নিদারুণ কথা? এখন কোথায় তুমি যাইবে? আমাকে ভাল করিয়া সকল কথা তুমি বল।”

 খেতু বলিলেন,— “তবে শুন। এই অট্টালিকার ভিতর যা ধন দেখিতেছি, ইহার প্রহরিণীস্বরূপ নাকেশ্বরী নামধারিণী এক ভয়ঙ্করী ভূতনী আছে। সুড়ঙ্গের দ্বারে সর্বদা সে বসিয়া থাকে। সেই যে খল-খল বিকট হাসি তুমি শুনিয়াছিলে, সে হাসি এই নাকেশ্বরীর। যে কেহ তাহার এই ধন স্পর্শ করিবে, মুহূর্ত্তের মধ্যে সে তাহাকে খাইয়া ফেলিবে। আমি এই ধন লইয়াছি। কিন্তু যে শিকড়টি তুমি দগ্ধ করিয়া ফেলিয়াছ, সেই শিকড়ের দ্বারা এতদিন আমি রক্ষিত হইতেছিলাম। তা' না হইলে এদিন কোন কালে নাকেশ্বরী আমাকে খাইয়া ফেলিত! শিকড় নাই, একাথ এখনও বোধ হয় জানিতে পারে নাই। কিন্তু শীঘ্রই সে জানিতে পরিবে। জানিতে পারিলেই সে এখানে আসিয়া আমাকে মারিয়া ফেলিবে। নাকেশ্বরীর হাত হইতে নিস্তার পাইবার কোনও উপায় নাই। এক তো এখান হইতে বাহিরে যাইবার অন্য উপায় নাই। তা থাকিলেও কোনও লাভ নাই। বনে যাই কি জলে যাই, গ্রামে যাই কি নগরে যাই, যেখানে যাইব, নাকেশ্বরী সেইখানে গিয়া আমাকে মারিয়া ফেলিবে।”

 এই কথা শুনিয়া, কঙ্কাবতী খেতুর পা-দুটি ধরিয়া সেইখানেই শুইয়া পড়িলেন।

 খেতু বলিলেন,— “কক্কাবতী! কাঁদিও না। কাঁদিলে আর কি হইবে? যাহা অদৃষ্ট ছিল, তাহা ঘটিল। সকলি তাঁহার ইচ্ছা। উঠ, যাও, আস্তে আস্তে সুড়ঙ্গ দিয়া বাহিরে যাও। এখনি নাকেশ্বরী এখানে আসিয়া পড়িবে। তাহাকে দেখিলে তুমি ভয় পাইবে। যাও, বাড়ী যাও; মা'র কাছে যাইলে, তবু তোমার প্রাণ অনেকটা সুস্থ হইবে।”

 কঙ্কাবতী উঠিয়া বসিলেন। আরক্তনয়নে আরক্তবদনে কঙ্কাবতী উঠিয়া বসিলেন। কঙ্কাবতীর মৃদু মনোমুগ্ধকারিণী সেই রূপমাধুরী উগ্র-ভাবাপন্ন হইয়া, এখন অন্যপ্রকার এক সৌন্দর্য্যের আবির্ভাব হইল।

 কঙ্কাবতী বলিলেন,— “আমি তোমাকে এইখানে ছাড়িয়া যাইব? তোমাকে এইখানে ছাড়িয়া নাকেশ্বরীর ভয়ে প্রাণ লইয়া পলাইব? তা যদি করি, তো ধিক আমার প্রাণে, ধিক আমার বাঁচনে! শত ধিক আমার প্রাণে। শত ধিক আমার বাঁচনে! তোমার কক্কাবতী অল্পবুদ্ধি

৭২
ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ