পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/৮৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বলিলেন,— “ভাল হইয়াছে। কাজ নাই। —কাজ নাই আর এ-জগতে থাকিয়া! চল আমরা এ-জগৎ হইতে যাই। নাকেশ্বরী আমাদের শক্র নয়,— নাকেশ্বরী আমাদের পরম মিত্র।”

 খেতু বলিলেন,— ‘কান পাতিয়া শুন দেখি! নাকেশ্বরীর কোনও সাড়াশব্দ পাও কি না?”

 কঙ্কাবতী একটু কান পাতিয়া শুনিলেন, তাহার পর বলিলেন,— “না— কোনরূপ সাড়াশব্দ নাই।”

 খেতু পুনরায় বলিলেন,— “তবে শুন, তাহার পর কি হইল। নাকেশ্বরী আসিতে আসিতে সকল কথা বলিয়া লই।”

 “যখন বুঝিলাম যে, আমার টাকাগুলি চুরি গিয়াছে, তখন মনে করিলাম,— 'আজ আমার সকল আশা নির্ম্মল হইল!' যে লোকটি আমার সঙ্গে গাড়ীতে ছিল, সে চোর। জলখাবারের সহিত সে কোনও প্রকার মাদকদ্রব্য মিশাইয়া দিয়াছিল। সেই জলখাবার খাইয়া যখন আমি অজ্ঞান হইয়া পড়ি, তখন সে আমার টাকাগুলি লইয়া পলাইয়াছে। কখন কোন ষ্টেশনে নামিয়া গিয়াছে, তাহা আমি কি করিয়া জানিব? সুতরাং চোর ধরা পড়িবার কিছুমাত্র সম্ভাবনা নাই। তবু, রেলের কর্ম্মচারীদিগকে সকল কথা জানাইলাম। আমাকে সঙ্গে লইয়া, সমস্ত গাড়ী তাহারা অনুসন্ধান করিলেন।”

 “কোনও গাড়ীতে সে লোকটিকে দেখিতে পাইলাম না। তখন আমি পৃথিবী শূন্য দেখিতে লাগিলাম। কঙ্কাবতী! এই যে মনুষ্যজীবন দেখিতেছি, কেবল কতকগুলি আশা ও হতাশা, এই লইয়াই মনুষ্যজীবন। কি করিব আর, কঙ্কাবতী? চুপ করিয়া রহিলাম। ভাবিতে লাগিলাম,— ‘এখন করি কি? যাই কোথায়? কলিকাতা যাই, কি কাশী ফিরিয়া যাই, কি দেশে যাই! তারপর মনে পড়িল যে, রাণীগঞ্জের টিকিটখানি, আর গুটিকত পয়সা ভিন্ন হাতে আর কিছুই নাই। যাহা হউক, হাতে পয়সা থাকুক আর নাই থাকুক, দেশে আসাই যুক্তিসিদ্ধ বিবেচনা করিলাম। কারণ তোমাকে বলিয়াছিলাম যে, এক বৎসর পরে ফিরিয়া আসিব। তুমি পথপানে চাহিয়া থাকিবে। হয়তো কত গঞ্ছনা, কত লাঞ্ছনা তোমাকে সহ্য করিতে হইতেছে! মনে করিলাম,— “তোমার বাপের পায়ে গিয়া ধরি, তাঁহাকে দুই হাজার টাকার খত লিখিয়া দিই, মাসে মাসে টাকা দিয়া ঋণ পরিশোধ করিব।' কঙ্কাবতী! বারবার তোমার বাপের কথা মুখে আনিতে মনে বড় ক্লেশ হয়। তিনি কেন যাই হউন না, তোমার পিতা তো বটে! তাঁর কথা বলিতে গেলেই যেন নিন্দা হইয়া পড়ে। মনে করিয়াছিলাম, 'এখান হইতে প্রচুর ধন দিয়া, ধনের উপর তাঁহার বিতৃষ্ণা করিয়া দিব!’ পৃথিবীর আর একটি রোগ দেখ, কঙ্কাবতী! ধনের জন্য সবাই উন্মত্ত। ধনের জন্য সবাই লালায়িত। পেটে কতকটি খাই, কঙ্কাবতী! গায়ে কি পরি? যে ধন-পিপাসায় এত তৃষিত হইব! হাঁ! ধন উপাৰ্জ্জনের আবশ্যক। কেন না, ইহা দ্বারা আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধবের উপকার করিতে পারা যায়, নিরাশ্রয়কে আশ্রয় প্রদান করিতে পারা যায়, ক্ষুধার্ত্তকে অন্ন দিতে পারা যায়, দায়গ্রস্তকে দায় হইতে মুক্ত করিতে পারা যায়, অনেক পরিমাণে দুঃখময় জগতের দুঃখ মোচন করিতে পারা যায়।”

 “যাহার দ্বারা অনেকের উপকার হয়, যিনি আমোদ-প্রমোদ বিরত হইয়া, ভোগ-বিলাস পরিহার করিয়া জগতের হিতের নিমিত্ত অর্থোপাৰ্জ্জনে বা জ্ঞানোপাৰ্জ্জনে সময় অতিবাহিত করেন, ত এই সংসারে তিনি দেবতাস্বরূপ। কিন্তু তা বলিয়া কঙ্কাবতী! ধনোেপাৰ্জ্জনে লোক যেন উন্মত্ত না হয়। জ্ঞানোপাৰ্জ্জনে ও ধনোপার্জ্জনে লোক উন্মত্ত হয় হউক। মেঘের বর্ষণ, প্রবল প্রভঞ্জনের গভীর গর্জ্জন পৃথিবীর নিম্ন প্রদেশেই ঘটিয়া থাকে। উৰ্দ্ধপ্রদেশে সেই মহা আকাশে সব স্থির, সব শান্ত। সেইরূপ মানবের এই কর্ম্মক্ষেত্রেও উচ্চতা-নীচতা আছে।

৭৬
ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ