পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/৮৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ধন মান জাতি ধর্ম্ম লইয়া যত কিছু কোলাহল শুনিতে পাও, অজ্ঞানতাময় নীচ-পথাশ্রিত মানবমন হইতেই সে সমুদয় উত্থিত হয়। এই মৃত্যু-সময়ে, মোহান্ধ, নিম্নপথাবলম্বী মানবকুলের বৃথা বাদ বিসংবাদ প্রত্যক্ষ দেখিয়া, কঙ্কাবতী! আমি আর হাস্য সংবরণ করিতে পারিতেছি না।”

 “কলিকাতা কি কাশী না গিয়া বাড়ী যাইব, এইরূপ মনে মনে স্থির করিয়া রাণীগঞ্জে নামিলাম। রাণীগঞ্জ হইতে আমাদের গ্রামে আসিতে দুইটি পথ আছে। একটি রাজপথ, যাহা দিয়া অনেক লোক গতিবিধি করে, দ্বিতীয়টি বনপথ, যাহাতে বাঘ-ভালুকের ভয় আছে, সেজন্য সে পথ দিয়া লোকে বড় যাতায়াত করে না। বনপথটি কিন্তু নিকট। সে পথটি দিয়া আসিলে পাঁচ দিনে আমাদের গ্রামে উপস্থিত হইতে পারা যায়, রাজপথ দিয়া যাইলে ছয় দিন লাগে। রাণীগঞ্জে যখন নামিলাম, তখন আমার হাতে কেবল চারিটি পয়সা ছিল। শীঘ্র গ্রামে পৌঁছিব, সে নিমিত্ত আমি বনপথটি অবলম্বন করিলাম। প্রথম দিনেই পয়সা কয়টি খরচ হইয়া গেল। পাহাড়-পর্ব্বত, বন-উপবন, নদী-নির্ঝর অতিক্রম করিয়া চলিতে লাগিলাম। বনের ফলমূল যাহা কিছু পাই তাহাই খাই। রাত্রিতে যেদিন গ্রাম পাই, সেদিন কাহারও দ্বারে পড়িয়া থাকি। যেদিন গ্রাম না পাই, সেদিন গাছতলায় শুইয়া থাকি। মনে করিলাম, 'আমাকে বাঘ-ভালুকে কিছু বলিবে না, তার জন্য কোন চিন্তা নাই। আমাকে যদি বাঘ-ভালুকে খাইবে, তবে পৃথিবীতে এমন হতভাগা আর কে আছে যে, দুঃখ সব ভোগ করবো?”

 “এইরূপে চারিদিন কাটিয়া গেল। আমাদের গ্রাম হইতে যে উচ্চ পর্ব্বতটি দেখিতে পাওয়া যায়, সন্ধ্যাবেলা আমি সেই পর্ব্বতের নিম্নদেশে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। সেই পর্ব্বতটি এই, যাহার ভিতর এক্ষণে আমরা রহিয়াছি। এখান হইতে আমাদিগের গ্রাম প্রায় একদিনের পথ। কয় দিন অনাহারে ক্রমেই দুর্ব্বল হইয়া পড়েছিলাম। মনে করিলাম, প্রাতঃকালে আরও দুর্ব্বল হইয়া পড়িব, তাহার চেয়ে সমস্ত রাত্রি চলি, সকালবেলা গ্রামে গিয়া পৌঁছিব। এইরূপ ভাবিয়া সে রাত্রিতে আর বিশ্রাম না করিয়া, ক্রমাগত চলিতে লাগিলাম! রাত্র একপ্রহরের পর চন্দ্র অস্ত যাইলেন, ঘোরতর অন্ধকারে বন আচ্ছন্ন হইল, আমি পথ হারাইলাম। নিবিড় বনের মধ্যে গিয়া পড়িলাম, কোনও দিকে আর পথ পাই নাই। একবার অগ্রে যাই, একবার পশ্চাতে যাই, একবার দক্ষিণে যাই, একবার বামদিকে যাই, পথ আর কোনও দিকে পাই না। অনেকক্ষণ ধরিয়া অতিকষ্টে বনের ভিতর ঘুরিয়া বেড়াইলাম, পথ কিন্তু কিছুতেই পাইলাম না। অবশেষে নিতান্ত ক্লান্ত হইয়া পড়িলাম। পা আর তুলিতে পারি না। পিপাসায় বক্ষঃস্থল ফাটিয়া যাইতে লাগিল। এমন সময়, সম্মুখে একটি মন্দির দেখিতে পাইলাম। মন্দিরটি দেখিয়া আমার মৃতপ্রায় দেহে পুনরায় প্রাণের সঞ্চার হইল। ভাবিলাম, অবশ্য এইস্থানে লোক আছে। আর কিছু পাই না পাই, এখন একটু জল পাইলে প্রাণরক্ষা হয়। এই ভাবিয়া, তৃষিত চাতকের ন্যায় ব্যগ্রতার সহিত মন্দিরের দিকে যাইলাম। হা অদৃষ্ট! গিয়া দেখিলাম, মন্দিরে দেব নাই, দেবী নাই, জনমানব নাই, মন্দিরটি অতি প্রাচীন, ভগ্ন; ভিতর ও বাহির বন্য বৃক্ষলতায় আচ্ছাদিত! বহুকাল হইতে জনমানবের সেখানে পদার্পণ হয় নাই। 'হা ভগবান! তোমার মনে আরও কত কি আছে!' এই বলিয়া দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া সেইখানে আমি শুইয়া পড়িলাম।”

কঙ্কাবতী
৭৭