পাতা:দিনের পরে দিন - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/১২৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দেখলাম, গায়ে চব্বি বোধহয় এক আউন্সও নেই, কিন্তু লোহার তারের মতো শক্ত দড়ি-দাড়ি হাত-পা। গলাটা যেন একটা বেশি লক্ষবা, চক্ষদটির দস্টি তীক্ষা, গলার হাড় বেরনো, চেহারায় দস্তুরমত বিশেষত্ব আছে। বার বার চেয়ে দেখতে ইচ্ছে হয়। পথে বেশ অন্ধকার হল। আমার একটি ভয় যে হয়নি, একথা বললে মিথ্যে কথা বলা হবে। সঙ্গে তিনজন অপরিচিত লোক, সাটকেসে কিছ টাকা-কড়িও আছে, জামায় সোনার বোতাম আছে, হাতঘড়ি আছে, এই পাহাড়ী জায়গায় এদের বিশবাস কি। জিজ্ঞেস করলাম—মনসার আর কতদার হে ? —আর বাবা তিন মিল। ওদের তিন মিল আর শেষ হয় না, তারপর দঘণ্টা কেটে গেল। ডুলির বাইরে বড় অন্ধকার হয়ে এসেচে, কিছ দেখা যায় না। তবে মনে হচ্ছে মাঝে মাঝে ছোট বড় পাহাড় পড়চে রাস্তার দ-ধারে, ঝরনার জলের শব্দও পাচ্চি। আজ দেবীপক্ষের সপ্তমী, অথচ মাঠ বন ঘটঘটে অন্ধকার। আরও কিছদক্ষণ পরে দরে অন্ধকারের মধ্যে দ-একটা আলো দেখা গেল। একটা ছোটমতো খালের হাঁটজেল পেরিয়ে আমরা মানসারে পৌছে গেলাম। ওরা বললে—বাব, আপনাকে থাকবার জায়গায় দিয়ে আসি। কাল সকালে এসে আবার আমরা দেখা করবো । একটা বড় চালাঘরে ওরা আমায় নিয়ে গেল। ঘরের সামনেটা একেবারে ফাঁকা, তিনদিকে কিসের বেড়া দেওয়া অন্ধকারে ভালো ঠাওর হল না। একটা আলো পয্যন্ত নেই, ভীষণ অন্ধকার। আমি তো অবাক, এ রকম ঘরে জিনিসপত্র নিয়ে রাত কাটাবো কেমন করে ? বললাম, এ কারো বাড়ি, না কি এটা ? আমাদের মন্ডপ-ঘর। সাধারণের জন্যে সাধারণের চাঁদায় তৈরী। এখানে থাকুন, কোনো ভয় নেই। আমি খােব আশাব্যস্ত হলাম না। আর কোনো কিছর ভয় না থাকলেও সাপের ভয় যে আছে, এ বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ। মধ্যপ্রদেশের এই সব বনাঞ্চলে শানেচি নাকি শঙ্খচড় (King Kobra) সাপের খাব প্রাদাভােব। ওদের বললাম কথাটা। ওরা আমায় নানাপ্রকারে আশাবাস দিলে। সাপ। কখনো তারা চোখে দেখেনি, সাপ কাকে বলে তারা জানেই না। আমি নিভয়ে এ ঘরে রাত্রিযাপন করতে পারি। কিন্তু সাপ যদি না-ও থাকে, এ খোলা জায়গায় চোরের ভয়ও কি নেই? নিশ্চয়ই এখনো এদেশে সত্যযােগ চলচে না। ওরা আমার কথা শনে হাসলে। চুরি নাকি এদেশে অজ্ঞাত। তাদের জ্ঞানে কখনো মানসারে চুরি হয়নি। বিশেষ করে বিদেশী লোকের জিনিস কেউ ছোটবেও না। আমাকেই রান্না করতে হল রাত্রে। যবের রাটি, ঢেড়সের তরকারি ও দধি । এদেশে আটার রাটি খাওয়ার প্রচলন তত নেই-বাজার থেকে আটা ময়দা এরা বড় একটা কেনে না। নিজেদের ক্ষেত্রোৎপন্ন যব, গম ও মকাই-এর রাটিই সারা বছর খায়। গম খাব বেশি হয় না বলেই তার সঙ্গে যাব ও মকাই যোগ না করলে বছর কাটে না। অনেক সময় যব, গম ও মকায়ের ছাতু-তিন দ্রব্যের সংমিশ্রণেও রাটি তৈরি করা হয়। রাত্রে সনিদ্রা হল। পরদিন সকালে উঠতেই গ্রামের অনেক লোক আমার সঙ্গে দেখা করতে এল। তাদের মখে খবর নিয়ে জানা গেল মাত্র পচিশ-ত্রিশ ঘর লোকের বাস ও-গ্রামে। প্রধান উপজীবিকা চাষ ও লাক্ষা সংগ্ৰহ । লাক্ষাকীট পোষা ও সংগ্ৰহ SS8