পাতা:দিনের পরে দিন - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/১৮২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শনে বাসায় ফিরছিলাম। পথে আসতে আসতে অনেক কালের একটা গলপ মনে পড়ল। আমার পলিসির অধ্যবসায়ের ঘটনাস্থল ছিল নবীন চক্কোত্তির বাড়ীর এদিকের এড়ো ঘরটা, এই গলপটার ঘটনাস্থলও ছিল তাই। কোন এক ভগ্নপোতে মহাসমাদ্রের কোন অংশে জানি না। অন্য সব যাত্রী, মাঝি-মাল্লাকে নামিয়ে দিয়ে জাহাজের অধ্যক্ষ অবশিস্ট একটা মাত্র লাইফবেলট পরতে যাচ্ছেন—এমন সময় তাঁর চোখে পড়লো জাহাজের এক কোণে এক ক্ষদ্র অপরিচিত বালক শীতে ভয়ে ঠক ঠক করে কাঁপছে। সে একজন stowawayলকিয়ে জাহাজে চড়ে কোথায় যাচ্ছিল—এতদিন খায়নি, ভয়ে, ও অনাহারে মতপ্রায় হয়ে পড়েছে। মহানভব পোতাধ্যক্ষ তাকে তাঁর জীবনরক্ষার শেষ উপায়টা দিয়ে মাতৃত্যুর জন্য নিজে প্রস্তুত হলেন এবং অলপক্ষণেই ঝঞ্চাক্ষব্ধ সমদ্রের তরঙ্গের গভো পোতসহ নিমজিজত হয়ে গেলেন। সেই কাপ্তেনের ছবিটা বেশ দেখতে পেলাম। পত্তাগালের কি সোপনের কোন দ্রাক্ষালতার বনের ধারে বসে নীলনয়ন-বালক আপনি নিজনে দরে দেশের সবপ্নে তার দেশের নাবিকেরা প্রাচীন কালে দেশকে ধনশালী করে ক্ষমতাশালী করে রেখে গিয়েছে—তারও মনে মনে ইচ্ছা যে সেও একদিন সেইরকম হবে। কটেজ কি পিজারোর মত রাজ্যস্থাপয়িতা দিগিবজয়ী বীর নাবিক। তারপর তার দরিদ্র পিতামাতার কুটীরে পোড়া রাটি খেয়ে শয়ে রাত্রে ঘামের ঘোরে সে দরের সবপ্নে আকুল হয়ে উঠতো। পিতামাতার অনেকগলো ছেলেমেয়ে, কেউ ভাল খেতে পায় না। শিক্ষার সহযোগই বা কে দেয় ? একদিন সবপ্নের সৌন্দয্যে আকুল হয়ে বালক বাড়ী থেকে পালিয়ে চলে গেল। তার কেউ খোঁজখবর করলে না। ক্ৰমে সকলে ভুলে গেল তাকে। কেবল তার মা তাকে মনে রাখলে। ধৰ্ম্মম মন্দিরে উপাসনার সময় সঙ্গীহীন, সেই নীলনয়ন পলাতক ছেলেটি তার ছিল নিত্যসঙ্গী। কত নিজজন রাত্রের চোখের জলে, রোগশয্যায় বিকারের ঘোরে তার কিশোর মাত্তি চোখে পড়েছে। মা যখন মারা গেল, ছেলে তখন সর্বপ্নকে সার্থকতার মধ্যে পেয়েছে। কত কাল চলে গিয়েছে...কত দেশের কত অদভত জীবন প্রবাহের মধ্যে দিয়ে সে বালক এখন প্রৌঢ় পোতাধ্যক্ষ। বিবাহ সে করেনি-বিশাল মহাসমাদ্রের তরঙ্গসঙ্গীত তার জীবনের বীণাকে চিরকাল রদ্রতালে বাজিয়ে এসেছে। সংসারের কোন বাঁধন নেই তার। অচিনের অনন্ত পথ ছেলেবেলাকার মতই তার সামনে তবও বিস্তৃত। ভীত, জড়সড়, ক্ষদ্র বালককে দেখে সে মরণের রাত্রে তার নিজের দর শৈশবের কথা মনে পড়ল। এই রকম অবোধ, হিতাহিতজ্ঞানশন্য বালক ছিল সে, যখন প্রথম অজানার টানে সে বাড়ী ছেড়ে পালিয়ে যায়। এই বালকও আজ সেরকম বেরিয়েছে, কিন্তু হতভাগ্য প্রথম বারেই জীবনকে বিপন্ন করে বসেছে। বালকের জীবনের বিস্তৃততর সখি আনন্দকে প্রসারলাভ করবার সংযোগ দেওয়ার জন্যে সে নিজের লাইফ-বেলট তখনি খালে তাকে পরিয়ে দিয়ে বললে—“বন্ধ, তোমারই মত বয়সে আমিও বাড়ী ছেড়ে পালিয়েছিলাম, আমার জীবন তো শেষ হয়ে এসেছে—তুমি বাঁচো, ভগবান তোমায় রক্ষা করনি।' আজ এই রাত্রে পড়াশনার একটা অদম্য পিপাসা মনের মধ্যে অনভব করছি। এক লাইব্রেরী বই পাই, সব বিষয়ে খাব বসে পড়ি। বিজ্ঞান কাব্য উপন্যাস-দেশবিদেশের কবিদের ও ঔপন্যাসিকদের বই পড়তে বড় ইচ্ছে করছে। জীবন বড় ক্ষণস্থায়ী। অন্য ব্যাপারে নন্ট করে কি করবো? শােধ পিপাসা—আমার এ পড়াশনার পিপাসা OS