পাতা:দিনের পরে দিন - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/২০৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

হাওয়ায় রণচুর ক্ষেতের পাশ দিয়ে দিয়ে গেলাম। কয়েকদিনের জড়তাটা কেটে গেল। ক্ষেতে ক্ষেতে যাব পেকেছে। পাকা ফসলের সগন্ধ চারধার থেকে পাওয়া যাচ্ছে। কখনো আমি ঘোড়া ছোটাই কখনো নায়েব মহাশয় ঘোড়া ছোটান। ফলকিয়ার সীমানা ছাড়িয়েই জঙ্গল থেকে একটা বনো মহিষ বার হ’ল। সেটার মাত্তি দেখেই আমি বললাম, এটা মারতে পারে, ঘোড়া ঘোরান মশাই। খাঁর দিয়ে মাটি খড়ে সেটা শিং নেড়ে লাল চোখে আমাদের দিকে চাইতে লাগলো। যদি তেড়ে মারতে আসে-দ্যজনে ঘোড়া ফিরিয়ে চালিয়ে খানিকটা এসে আবার দাঁড়িয়ে গেলাম —ততক্ষণ মহিষটা চলে গিয়েছে। তারপর আমরা ঘোড়া ফিরিয়ে কমলাকুন্ডু পৌছলাম। খাব রোদ চড়েছে, কলবলিয়াতে স্নান করতে গেলাম। ঠান্ডা জলে নাইতে নাইতে ভাবছিলাম-ঐ আমাদের ইছামতী নদী। আমি একটা ছবি বেশ মনে করতে পারি—এই রকম ধধে বালিয়াড়ী পাহাড় নয়, শান্ত, ছোট, স্নিগন্ধ ইছামতীর দাপাড় ভরে ঝোপে ঝোপে কত বনকুসম, কত ফলে ভরা ঘোঁটবন, গাছপালা, গাঙশালিকের বাসা, সবজি তৃণাচ্ছাদিত মাঠ। গাঁয়ে গাঁয়ে গ্রামের ঘাট, আকন্দ ফল। গত পাঁচশত বৎসর ধীরে কত ফােল ঝরে পড়ছে-কত পাখী কত বনঝোপ আসছে যাচ্ছে। স্নিগ্ধ পাটা শেওলার গন্ধ বার হয়, জেলেরা জাল ফেলে, ধারে ধারে কত গহসেথর বাড়ী। কত হাসিকান্নার মেলা। আজ পাঁচশত বছর ধরে কত গহস্থ এল, কত হাসিম খ শিশ প্রথম মায়ের সঙ্গে নাইতে এল-কত বৎসর পরে বন্ধাবস্থায় তার শমশানশয্যা হ’ল ঐ ঠান্ডা জলের কিনারাতেই, ঐ বাঁশবনের ঘাটের নীচেই। কত কত মা, কত ছেলে, কত তরণ-তরুণী সময়ের পাষাণবত্মা বেয়ে এসেছে গিয়েছে মহাকালের বীথিপথ বেয়ে। ঐ শান্ত নদীর ধারে ঐ আকন্দ ফল, ঐ পাটা শেওলা, বনঝোপ, ছাতিমবন। এদের গলপ লিখবো, নাম হবে ইছামতী। সন্ধ্যার পর কমলাকুণডু থেকে বেরলাম। দিব্যি জ্যোৎসনা উঠেছে। বালার উপর চকচকে জ্যোৎস্না! জয়পালের নৌকাতে পার হতে হতে বড় ভাল লাগছিল। আর ভাবছিলাম—আজি বহিস্পতিবার, এই জ্যোৎস্নায় আমাদের দেশে দারিঘাটের পলের কাছ দিয়ে এসময় হাট করে কেউ হয়তো ফিরছে। রাত্তিরে কারা মাছ ধরছে—রাজ সিং জালসমেত ধরে নিয়ে এল, ছেড়ে দিলাম। তারপর ফিনিকফোটা জ্যোৎসনা রাত্রে কাশীবনের মধ্য দিয়ে আমি ও নায়েব পাশাপাশি ঘোড়া ছটিয়ে এসে সীমানার কাছে যেখানে ওবেলা মহিষ দেখেছিলাম। ওখানে এলাম। মনে হ’ল দরে আমার বাড়ী। এই জোৎস্না-ওঠা সন্ধ্যায় মারা সঞ্চিত হড়িকলসীগলো পড়ে আছে জঙগালভরা ভিটোতে। মার হাতের সজনে গাছটা এই ফাগান দিনে জঙ্গলের মধ্যে ফলে ভিত্তি হয়ে উঠছে। কেউ দেখছে না, কেউ ভোগ করছে না। হরি রায়ের জমিটকু নেবার কথা মা যখন সইমকে অনরোধ করেছিলেন, তখন তিনি জানতেন না যে ছেলে তাঁর ঘরকুনো গোরস্ত গোছের ছাপোষা গেয়ো মানষ হবে না। সে দেশে দেশে বহন দরে বহন সমাজে পাহাড়ে পন্বত ঘোড়ায় সন্টীমারে ট্রেনে—সারা জগতের অধিবাসী হয়ে বেড়াবে। জীবনের যাত্রাপথের সে হবে উৎসাহী উন্মত্ত পথিক-পথের নেশাতেই ভোর। মা ছিলেন গহলক্ষী, দরিদ্র ঘরে বিবাহ হওয়া পয্যন্ত এসে অলপ জিনিস সাজিয়ে গছিয়ে চালিয়ে গিয়েছেন। সেই চাল ভাজা—সেই সব। ঘরকান্না সাজাবার বন্ধি যেমন মেয়েদের থাকে, তার বেশী তারা কিছ জানে না, বোঝেও না, মাও ছিলেন তেমনি। মা চিরদিন ঐ বাশবনের ঘাটে, তেতুলতলার শান্ত জীবনযাত্রা, সঙ্কীণ ছোট গণডেীর মধ্যেই কাটিয়ে গিয়েছেন- সে জীবনের বাইরে তিনি অন্য কোনো 66