পাতা:দিনের পরে দিন - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/২৪৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সনান সেরে এসে বকুলতলার ছায়ায় বসে ওপরের কথাগালো লিখলাম। মাথার ওপর কেমন পাখীরা ডাকচে-ফিঙে, দোয়েল, চোখ-গোল—আর একটা কি পাখীপিড়িং করে ডাকচে, কত কি অসফট কলকাকলী—কি ভালই লাগে। এদের a . . . আজ বৈকালে হাট থেকে এসে কুঠির মাঠে অনেকক্ষণ বসলাম। শিমল-গাছের এত অপরােপ শোভা তা তো জানতাম না। ঝোপের মাথায় মাথায় কি নতুন কাঁচি লতা সাপের মত খাড়া হয়ে আছে। মন পরিপর্ণ হয়ে গেল সৌন্দয্যের ভারে-- চারিধারে চেয়ে—এই প্রকৃতির সঙ্গে, পাখীর গানের সঙ্গে মানষের সখে-দঃখের যোগ আছে বলেই এত ভাল লাগে। গ্রাম-প্রান্তরে সন্ধ্যাছায়াচ্ছন্ন বেণ বনশীর্ষের দিকে চেয়ে মনে হল ওদের সঙেগ কতদিনের কত সন্মতি যে জড়িত-সেই বিষার রাতে দিদির কথা, মায়ের কত দঃখ, আতুরী ডাইনীর ব্যর্থতা, পিসিমা ইন্দির ঠাকরণের, —কত সমন্দ্রে যাওয়ার সমিতি—সেই পিটলিগোলা-পানকারী দরিদ্র বালকের, পল্লীবালা জোয়ানের, কতকাল আগের সে-সব ইংরাজ বালক-বালিকার, গাং-চিল পাখীর ডিম সংগ্রহ করতে গিয়ে যারা বিপন্ন হয়েছিল— Cape Wan-এর ওদিকে গিয়ে যারা আর ফেরেনি—ক’ত কি, কত কি। নদীজািলও আজ লাগল। অদভূত-শান্ত সন্ধ্যা-কেউ নেই। ঘাটে, ওপারের গাছপালায় ধসের সন্ধ্যা নেমেচে—একটি নক্ষত্র উঠেচে মাথার ওপর—কোনো অনন্ত দেশের বাণীর মত এই শত দৈন্যসংকীর্ণ তাময় সংসারের উদ্ধে জবল জবল করে জবালচে । এখানকার বৈকালগলো কি অপব্ব ! এত জায়গায় তো বেড়িয়েচি, ইসমাইলপত্র, ভাগলপাের, আজমাবাদ-কিন্তু এখানকার মত বৈকাল আমি কোথাও দেখোঁচি বলে মনে হয় না—বিশেষ করে বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাসের মেঘহীন বৈকালগলি —যেদিন সাহায্য অস্ত যাবার পথে মেঘাবত না হয়, শেষ রাঙা আলোকটকু পৰ্য্যন্ত বড় গাছের মগডালে হালকা সিদরের পোঁচের মত দেখা যায়—সেদিনের বৈকাল। গাছের ও বাঁশবনের ঘন ছায়ায় চাপা আলো, ডাঁশা খেজর ও বিলবপলেপির অপব্ব সারভি মাখানো, নানা ধরনের পাখী-ডাকা, মিষ্ট সে বৈকালগলিতে এমন সব অদভুত ভাব মনে এনে দেয়, দ-একটা পাখী ধাপে ধাপে সারা উঠিয়ে কোথায় নিয়ে তোলে—কি উদাস, করণ হয়ে ওঠে তখন চারিদিকের ছবিটা, বিশেষ করে আমি যখন আমাদের ভিটে ও ঠাকুমাদের বেলতলাটায় গিয়ে খানিকক্ষণ বসেছিলাম, তখন—তার আর বণনা দেওয়া যায় না! আজ জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ, কিন্তু এখনও বিলবপল্পের গন্ধ সািবত্র, পাখীর ডাকের তো কথাই নেই-সৌদালিফােল এখনও আছে, তবে পািব্বাপেক্ষা যেন কিছ: কম । আমাদের বাগানে এখনও আমি আছে, আজ সকালে নদী থেকে আসবার পথে লক্ষ্য করে দেখলাম, এখনও লোক তলায় তলায় আম কুড়চ্চে। এ সৌন্দয্য ছেড়ে কোথাও নড়তে ইচ্ছে করে না। তা ছাড়া ভেবে দেখলাম, যত স্থানে বেড়িয়েচি, আনন্দ সব চেয়ে বেশী গাঢ় ও উদাস ভাবে আমি পাচ্চি শািন্ধ এই এখানে—কোনো Cosmic thoughts আটকায় না, বরং স্ফীতিপ্রাপ্ত হয়—খব ভাল করে ফোটে। তবে এই অপব্ব সৌন্দয্যের মধ্যে দিনরাত ডাবে থাকা যায় বলেই এখানে কোনো শ্রমজনক কাজ করা সম্পভব হয় না দেখলাম। বিকেল হতে না হতে কেবল মন আনােচান করে—রাত্ৰিতে কাজে মন বসে না-এ যেন Land of Lotuseaters. কোনো শ্রমসাধ্য কাজ এখানে সম্পভবপর নয়, সেই জন্যই কলকাতা ফিরতে চাচ্চি দী-একদিনের মধ্যে। আজকাল দিনগালো একেবারে মেঘমক্ত, রাত্রি জ্যোৎস্নায়