পাতা:দিনের পরে দিন - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৩১৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিকেলে একটি মেঘ করেছিল। গঙ্গাচরণের দোকানে কবিরাজ মশাইয়ের সঙ্গে গলপ করছিলাম। আমি বললাম-কি রাঁধলেন, কবিরাজ মশাই ?-কণ্টিকারীর ফল ভাজা আর ভাত। এই কবিরাজটি বড় অদ্ভুত মানষ। বয়স প্রায় সত্তর হবে, কিন্তু সদানন্দ, মক্তপ্রাণ লোক। কোন দেশ থেকে এদেশে এসেচে কেউ জানে না। বিশেষ কিছ হয় না। এই অজ পাড়াগাঁয়ে। তবও আছে, বলে--এদেশের ওপর মায়া বসে গিয়েচে। সৌদালি ফল দিয়ে একটা বালিশ তৈরি করেচে, সেই মাথায় দিয়ে শয়ে "থাকে । একটা পরে ঘন মেঘ করে এল। বেলেডাঙার ওপারে বাঁশবনের মাথার ওপরকার আকাশে যে কি সনীল নিবিড় মেঘসভজা! মেঘের কোলে আহ্বার একসারি বক উড়ল। কি রােপ যে হোল, আমি বমিন্টর ভয়ে পালাচ্ছিলাম, কিন্তু সৌন্দৰ্য্য দেখে আর নড়তে পারি নে। কে একটি মেয়ে নদীর এপারে কালো চলের রাশি খলে দাঁড়িয়ে আছে। কি চমৎকার ছবিটি! আজ বেশ মনের আনন্দ নিয়েই সকাল সকাল বেলেডাঙা গিয়েছিলাম। তখনও চারটের গাড়ি যায় নি। গঙ্গাচরণের দোকান খোলে নি। আইনদিদার বাড়িতে তেলপড়া নেবার জন্যে পাঁচী পাঠিয়েছিল আমার সঙ্গে জগোকে ও বধোকে। আইনন্দির বাড়িতে ছেলেবেলাতে একবার গিয়েছিলাম, ওর ছেলে আহাদ মন্ডল তখন বেচে ছিল। আইনন্দির বাড়িটা কি চমৎকার স্থানে! সেখান থেকে দরের মেঘভরা আকাশের নীচে প্রাচীন বট অশবথের সারি কি অদ্ভুত দেখাচ্ছিল! আইনন্দি চকমকি ঠিকে সোলা ধরিয়ে তামাক সাজলে ও একটা সোলা ফটাে করে আমায় তামাক খেতে দিলে। তারপর সে কত গলপ করলে বসে বসে। ১২৯২ সালে সে প্রথম এদেশে এসে বাস করে। তখন তার বয়েস বিয়াল্লিশ বছর। সে বছর বন্যার জল উঠেছিল তার উঠোনে। মরা গােঙ তখন ইছামতী ছিল, একথা কাল মতি মন্ডলও জলের ওপর দাঁড়িয়ে আমায় বলেছিল। আইনদি বললে-বড় ফতি করেচি মশাই, যাত্রার দলে গাওনা করেচি, বহরোপী সেজেচি, বেহালা বাজিয়েচি। আপনাদের শাস্তরটা খাব পড়েচি। ধারো গিয়ে বের ষোকেতু, সীতার বনবাস, বিদ্যেসািন্দর সব আমার মখস্থ। তারপর সে বিদ্যাসন্দর’ থেকে খানিকটা মখস্থ বলে গেল। মহাভারত থেকে ‘দাতাকৰ্ণ খানিকটা বললে। এখন ওর বয়েস নব্বইয়ের কাছাকাছি, এই বয়সেও সে নিজে চাষবাস দেখে। সে হিসাবে আমি তো নব্য যািবক। আমার সামনে এখন কত সময় পড়ে আছে। মনে করলে কত কাজ করতে পারি। কাল মতি মন্ডলকে ঘনি তুলতে দেখেও ঠিক এই কথাই মনে হয়েছিল। আইনন্দির বাড়ি থেকে সন্দেরপরের পথে খানিকটা বেড়াতে গেলাম। মরগাঙের বাঁকে দাঁড়িয়ে আরামডাঙার ওপারের চক্রাকার আকাশের নীলমেঘের সভজার দােশ্য যেন মনকে কতদরে কোথায় নিয়ে গিয়ে ফেলেছিল। পথে আসতে আসতে একটা করণ দশ্য দেখে সন্ধ্যাবেলাটা মন বড় খারাপ হয়ে গেল। গোয়ালাদের একটা ছোট মেয়েকে তার মা ঘরের উঠোনে এমন নিষ্ঠারভাবে মারচে, আর মেয়েটা কাঁদচে । আহা, নিজের সন্তানের ওপর অত নিম্ঠারভাবে হাত ওঠায় কি করে তাই ভাবি ! কি করবো, আমার কিছই করবার নেই। এদিকে বান্টি পড়াচে টিপ টপ করে, সঙ্গে দটাে ছোট ছোট ছেলে, তাড়াতাড়ি কুঠীর মাঠের বনের পথ দিয়ে আমাদের আর বছরের চড়াইভাতির জায়গাটা বধোকে আর জগোকে একবার দেখিয়ে--তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে এলাম।