পাতা:দিনের পরে দিন - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৩১৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ছেলের বিয়ের সম্পবদ্ধ করতে যাচ্ছে। ওকে দেখে বড় আনন্দ হয়-শান্ত, সরল, সাধপ্রকৃতির লোক বলে বাল্যকাল থেকে ওকে আপনার-জনের মত দেখি। বেলা যাব-যাব হয়েচে দেখে একটা জোর-পায়ে পথ হাঁটতে শার করলাম। খব রাঙা রোদ উঠেচে চারি ধারে। খাবােরাপোতা ছাড়লাম, সামনে আইনন্দির বাড়ির পেছনের প্রাচীন বটগাছটা, আইনন্দির বাড়ির মোড় থেকে দেখতে পাওয়া সেই দরপ্রসারী দিশবালয়-আজ আবার মেঘভাঙা রাঙা অস্ত-সায্যের রোদ পড়েচে দারের সেই সব বাঁশবন, শিমলবনের মাথায়, ঝিঙে ক্ষেতে ফল ফটেচে, বৈশাখের গায়ক পাখী পাপিয়া আর 'বৌ-কথা-কও’ চারিদিকে ডাকচে, বেলেডাঙার হাজারী ঘোষ গোেরর পাল নিয়ে নীতিডাঙার খড়ের মাঠ থেকে বাড়ি ফিরচে, মেয়েরা মরগাঙের ঘাট থেকে কলসী করে জল নিয়ে যাচ্ছে,-কি সন্দের শান্ত গ্রাম্য দশ্য, একবার মনে হ'ল পাট-শিমলের সেই কালীবাড়ি ও দেবোত্তর বাঁশঝাড়ের কথা। আজ দােপারবেলা সেখানে ছিলাম, কালীবাড়ির পেছনের এক গহর্সেথর বাড়ির বেী প্রতিবেশিনীকে ডেকে বলছিল-ও সেজ বো, একটা তরকারী দেবো, খাকীকে দিয়ে বাটি পাঠিয়ে দ্যাও তো! সন্ধ্যার আগে কতদর এসে গিয়েচি। সন্ধ্যাও হ’ল, বাড়ি এসে পা দিলাম, আমার পথ চলাও ফরল। আজ শরতের অপব্ব দাপরে পাগল করেচে। আমায়। অনেক দিন লিখি নি— নানা গোলমালে অবসাদে মনটা ভাল ছিল না—আজ রবিবার দিনটা দাপরে একটা ঘামিয়ে উঠেচি—কি পরিপািণ ঝলমলে শরতের দর্পাের। এর সঙ্গে জীবনের কি যে একটা বড় যোগ আছে-ভাদ্রমাসের এই রোদভরা দােপরে কেন যে আমায় পাগল করে তোলে। বনে বনে মটরলতার কথা মনে পড়ে, ইছামতীর ঘোলা জল, পাখীর ডাকমনটা যেন কোথায় টেনে নিয়ে যায়! সব কথা প্রকাশ করা যায় না। --কারণ আনন্দের সবটা কারণ আমারই কি জানা আছে ? কি করাচে খকু এই শরৎ দর্পরে, বকুলতলায় ছায়ায় ছায়ায়, একথাও মনে এসেছে। ওর কথা ভেবে কষ্ট হয় যে, ওর লেখাপড়া কাল দিনটি বড় সন্দের কেটেচে, তাই আজ মনে হচ্চে আজ সকালটিও বড় চমৎকার। অনেকদিন কলকাতায় একঘেয়ে জীবনযাত্রার পরে কাল বাড়ি গিয়েছিলাম। প্রথমেই তো খয়রামারি মাঠে দাপরের রোদে বেড়াতে গিয়ে সবজি গাছপালা লতাপাতার গন্ধে নতুন জীবন অন্যভব করলাম। হাওয়াতেও একটা তাজা গন্ধ আছে যা কিন্তু শহরে নেই। ঝোপে থোলো থোলো মাখম শিমের নীলফােল ফটেচে, মটরলতার সবজি ফল ও সৌদালি গাছের কাঁচা সাঁটি বন-জঙ্গলের শোভা কত বাড়িয়েচে—তাদের ওপর আছে। শরতের মেঘমাক্ত সনীল আকাশ, আর আছে তপ্ত সৰ্য্যোলোক। প্রতিবারই দেখোঁচ নতুন যখন কলকাতা থেকে আসি এমন একটা আনন্দ পাই! মনে হয়। এই তো নীলাকাশ আছে মাথার ওপর, চারিপাশে বেন্টন করে রয়েছে ঘন সবজি গাছপালার ঝোপ, পাখীর ডাক আছে, বনফলের দলনিও আছে-এ থেকে তো এতই আনন্দ পাচ্চি-তবে কেন মিথ্যে পয়সা খরচ করে দরে যাই! দরে আমায় কি দেবে, এমন কি দেবে, যা এখানে আমি পাচ্চি নে ? আসল কথা দরও কিছ নয়, নিকটও কিছ নয় - প্রকৃতি থেকে আনন্দ সংগ্রহ করবার মত মনের অবস্থা তৈরী হয়ে যদি যায়। তবে যে কোনো জায়গায় বসে দটো গাছপালা, একটখানি সবজি ঘাসে ভরা মাঠ, দটো বন্য পক্ষীর কলকাকলী, বনফলের শোভাতেই পরিপািণ আনন্দ লাভ করা যায়।