পাতা:দিনের পরে দিন - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৪৩২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

এখন রাত ১২টা। বসে ডায়েরীটা লিখচি। শিলং বেড়াতে যাব বলে গোছগাছ করতে বড় ব্যস্ত আছি। কমাস ধরে কি ছটােছটিটাই করে বেড়াচ্চি কলকাতায় । এখানে মিটিং, ওখানে engagement, এখানে পাটি, হয়তো আসলে দেখচি যে টাকাকড়ি নিতান্ত মন্দ আসচে। না, কিন্তু অনভূতির বৈচিত্র্য ও গভীরতা ওখানে কৈ ? উত্তেজনা থাকে বটে কিন্তু সত্যিকার আনন্দ নেই। এই যে শেষ শরতের অপব রােপ এবার-এমন রােপ দেখতেই পেলাম না, গাছপালার নবীন সরসতা উপভোগ করতেই পেলাম না, কলকাতায় এই হৈ-চৈ গন্ডগোলপািণ জীবনের জন্যে। তাই কাল সারাদিন এখানে ওখানে শত কাজ ও ব্যস্ততার পরে ফিরে এসে রাত্রে শয়ে ভাবছিলাম। এ হৈ-চৈ এর সার্থকতা কি ? আমার মনের একটা ব্যাপার আছে বরাবর লক্ষ্য করে দেখে এসেচি-সেটা মাটি ও গাছপালার সাহচয্যে বড় ভাল থাকে। সেখানে মন অন্য এক রকমই থাকে, শহরে শত কম্পমব্যস্ততার মধ্যে তা হয় না। আনন্দ পাইনে, আমোদ পাই। শান্ত অনভূতি নেই, উত্তেজনার প্রাচয্য আছে। অনেকে বলে—এই তো জীবন! পতুিপর্তু মিনমিনে জীবন আবার জীবন নাকি ? এই রকমই তো চাই! অভিজ্ঞতার দিক থেকে এ শহরের জীবনে অনেক কিছল পাবার ও নেবার আছে বটে স্বীকার করি, কিন্তু মনন ও ধ্যানের অবকাশ নেই। প্রকৃতির সঙ্গে যোগ না। রাখলে হয়তো অপরের চলতে পারে, কিন্তু আমার তো একেবারেই চলে না। কি করাচি এসব করে ? কার কি উপকার করাচি ? কারোরই না। আমার আগে কত লোকে এরকম হৈ-চৈ করে বেড়িয়ে গিয়েছে, কত মিটিং-এর সভাপতিত্ব করেচে, কত সাহিত্যসম্মেলনের পান্ডা হয়েচে, কত ব্যান্ডেক কত চেক কেটেচে-কোথায় তারা আজি P কে চেনে আজ তাদের ! গভীর অনভূতির আনন্দ জীবনে সার্থকতা আনে—অন্ততঃ আমার। অপরের কথা জানিনে, কিন্তু আমি ওর চেয়ে বেশী আনন্দ কিছতেই পাইনে। এত কোলাহলের মধ্যে থেকে বড় কোলাহল-প্রিয় হয়ে উঠোঁচি বটে, কিন্তু এ আমি সত্যিই ভালবাসিনে। আমার মন ভেতরে ভেতরে হাঁপিয়ে উঠচে একটখানি নীল আকাশের জন্যে। শরতের বনভূমির, মটর লতার ফল ও বনসিমের ঝোপের জন্যে, কাত্তিকের প্রথমে গাছপালার, বনতারা ফলের সে অপব্ব সাগন্ধের জন্যে। কাল যখন আসাম মেলে বেরতে যাব, তখন কলকাতায় এল। ভয়ানক ব্যষ্টি। একটা বড়ো রিকশাওয়ালাকে বললাম, আমায় মীজাপাের সন্ট্রীটে নিয়ে চল। সে কালা ও বোকা। তাকে ধমক দিতে দিতে মেস পৰ্য্যন্ত নিয়ে এলাম, তারপর মালপত্র নিয়ে সেন্টশনে আসতে আসতে তার রিকশার চাকা গেল ভেঙে। তাকে দিলাম মাত্র দ্য আনা। সে প্রতিবাদ না করে নীরবে চলে গেল। তার প্রতি এই নিষ্ঠর ব্যবহার করে যে কতটা অন্যায় করলাম, তা বঝলাম পরে। যত ভাল দশ্য দেখি ততই সকলের আগে আমার মনে পড়ে রিকশাওয়ালার সেই কারণ মািখটা। পৰ্যন্ত বন্যার জলে ডাবে আছে। ঠিক আমাদের দেশের মত বন্যা এসেচে। এখানেও, সৰস্বত্রই এবার বন্যা, এ পথে ১৯২২ সালের পরে আর কখনও আসিনি, এবং হাডিঞ্জ ব্রিজ পার হইনি। ১৯২১ সালের পরে। তিস্তা ব্রিজ পার হইনি। ১৯০৬ সালের পরে আর কখনও। সেই এসেছিলাম। বাবার সঙ্গে রংপরে, তখন আমি আট-ন বছরের বালক। কত জল তার পরে গঙ্গা দিয়ে বয়ে চলে গিয়েচে! (ইংরেজি ইডিয়মটি বড় লাগসই, ব্যবহার করবার প্রলোভন সংবরণ করতে পারলাম না।)