পাতা:দুর্গেশনন্দিনী বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.djvu/১২৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
কুসুমের মধ্যে পাষাণ
১২১

 ওস্মান এই সকল আলােচনা করিয়া রাজপুত্ত্রের পুনর্জীবনে যত্নবান্ হইয়াছিলেন, সন্দেহ নাই, কিন্তু আর কিছুও ছিল। কাহারও কাহারও অভ্যাস আছে যে, পাছে লােকে দয়ালু-চিত্ত বলে, এই লজ্জার আশঙ্কায় কাঠিন্য প্রকাশ করেন এবং দানশীলতা নারী-স্বভাব-সিদ্ধ বলিয়া উপহাস করিতে করিতে পরােপকার করেন। লোক জিজ্ঞাসিলে বলেন, ইহাতে আমার বড় প্রয়ােজন আছে। আয়েষা বিলক্ষণ জানিতেন, ওস্মান তাহারই একজন। হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “ওস্মান! সকলেই যেন তােমার মত স্বার্থপরতায় দূরদর্শী হয়। তাহা হইলে আর ধর্ম্মে কাজ নাই।”

 ওস্মান কিঞ্চিৎকাল ইতস্ততঃ করিয়া মৃদুতর স্বরে কহিলেন, “আমি যে পরম স্বার্থপর, তাহার আর এক প্রমাণ দিতেছি।”

 আয়েষা নিজ সবিদ্যুৎ মেঘতুল্য চক্ষুঃ ওস্মানের বদনের প্রতি স্থির করিলেন। ওস্মান কহিলেন, “আমি আশালতা ধরিয়া আছি, আর কত কাল তাহার তলে জলসিঞ্চন করিব?”

 আয়েষার মুখশ্রী গম্ভীর হইল। ওস্মান এ ভাবান্তরেও নূতন সৌন্দর্য্য দেখিতে লাগিলেন। আয়েষা কহিলেন,“ওস্মান! ভাই বহিন্ বলিয়া তােমার সঙ্গে বসি দাঁড়াই। বাড়াবাড়ি করিলে, তােমার সাক্ষাতে বাহির হইব না।”

 ওসমানের হর্ষোৎফুল্ল মুখ মলিন হইয়া গেল। কহিলেন,—“ঐ কথা চিরকাল! সৃষ্টিকর্ত্তা! এ কুসুমের দেহমধ্যে তুমি কি পাষাণের হৃদয় গড়িয়া রাখিয়াছ?”

 ওস্মান আয়েষাকে মাতৃগৃহ পর্য্যন্ত রাখিয়া আসিয়া বিষণ্ণ-মনে নিজ আকাসে-মন্দির মধ্যে প্রত্যাগমন করিলেন। আর জগৎসিংহ? বিষম জ্বর-বিকারে অচেতন শয্যাশায়ী হইয়া রহিলেন।