পাতা:দৃষ্টিপ্রদীপ - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/১৫৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দিন, রাত, সকাল, সন্ধ্যা?-এই বিক্রমশিলা বিহারের পাহাড়মালা, বন-শ্রেণী পাদমূলে প্রবাহিত পুণ্যস্রোতা নদী, সন্ধ্যার পটে রাঙা সূৰ্য্যাস্ত, বানচামেলীর উগ্ৰ উদাস গন্ধ-এ-সবের মধ্যে সে আছে, তার হাসি নিয়ে, তার মুখভঙ্গি নিয়ে, তার গলার সুর নিয়ে, তার শতসহস্ৰ টুকরো কথা নিয়ে, তার ছেলেমানুষি ভঙ্গি নিযে। কেন তাকে ভুলি নি, কেন তার জন্য আমার মন সর্বদাই উদাস, উন্মুখ, ব্যাকুল, বেদনায় ভরা, স্মৃতির মাধুৰ্য্যে আধুত, নিরাশায় যন্ত্রণাময়-হঠাৎ তাকে এত ভালবাসাল্লুম কেন ? তার কথা মনে যখন আসে, তখন কেণ্ডলিন খনির উপরকার পাহাড়চূডাটায় একটা বাকাইন গাছের গুডিতে ঠেস দিয়ে সারাদিন তার কথা ভাবি-খাওয়া-দাওয়ার কথা মনে থাকে না, ভালও লাগে না-তার মুখের হাসির স্মৃতিতেই যেন আমার শাস্তিময় নিভৃত গৃহকোণ, তার কথার সুর দূরের ব্যবধান ঘুচিয়ে, মােঠ নদী বন পাহাড় পার হয়ে ভেসে এসে আমার প্রদীপ-জালানো শান্ত আঙিনার ছোট খড়ের রান্নাঘরের একপাশে উপবিষ্ট নিরীহ গৃহস্থ সাজায়-জীবনে তাই যেন চেয়ে এসেছি, সব দুরাশা, সবা-কিছু ভুলিয়ে দেয, অতীত, বৰ্ত্তমান ও ভবিষ্যৎ একাকার হয়ে যায়--- এদিকে রোদ চড়ে ওঠে কিংবা সূৰ্য্য ঢলে পড়ে, বটেশ্বরনাথের পাহাড রঙে রঙে রাঙা হয়, পাখীর গান হঠাৎ যায় থেমে-সাধুজীর চেলা বৰ্ম্মানারায়ণ আমাকে খুঁজতে আসে চা খাবার জন্যে।--তখন অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠতে হয়-গাঁজার ধোঁয়ায় অন্ধকার সাধু-বাবাজীর গুহার সামনে ব’সে দুধাবিহীন কড়া চা খেতে খেতে হনুমান-চরিত শুনতে হয় । সাধুজী আমাকে ভালবাসেন। এই জন্যেই ওঁর এখানে আছি। এখানে পয়সার খরচ নেই বললেই হয়। বারোটা টাকা এনেছিলুম, সাধুজীর হাতে তুলে দিয়েছি-নিতে চান নি। -আমি পীড়াপীড়ি ক’রে দিয়েছি। একবেলা খাই মকাইয়ের ছাতু, একবেলা রুটি আর ঢেড়সের তরকারি। অন্য কিছু এখানে মেলে না। কেওলিন খনির ম্যানেজার মাঝে মাঝে কহলগাও থেকে মাছ আনায়, সেদিন ওর বাংলোতে আমায় খেতে বলে—কারণ সাধুর এখানে ওসব কায়বার হবার জো নেই। মালতীর সঙ্গে আবার দেখা হবে না ? কিন্তু কি ক’রে হবে তা তো বুঝি নে। আমি আবার সেখানে কোন ছুতোয় যাবো ? উদ্ধবদাস-বাবাজী আমায় ভাল চোখে দেখতে না । দু-একবার অসন্তোষ প্ৰকাশও করেছিল, মালতীর সঙ্গে যখন বড় মিশছি--তখন দু-একবার আমায় এমন আভাসও দিয়েছিল যে এখানে বেশী দিন। আর থাকলে ভাল হবে না । ও-সবে আমি ভয় করি নে। সপ্তসিন্ধুপারের দেশ থেকে মালতীকে আমি ছিনিয়ে আনতে পারি, দি আমি জানতাম যে মালতী’ও আমায় চায়। কিন্তু তাতে আমার সন্দেহ আছে । সেই সন্দেহের জন্যেই যত বেদনা, যা-কিছু যন্ত্রণা! কি জানি, বুঝতে পারি। নে সবখানি । রহস্যময়ী মালতীর মনের খবর পুরো এক বছরেও পাই নি । YE