পাতা:দৃষ্টিপ্রদীপ - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/১৯৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

-এতদিন কোথায় ছিলেন ? বেশ তো লোক । সেই গেলেন আর আসবার নামটি নেই ? হয়ত দু-বছর আগেও এ কথা কেউ বললে বেদনাতুর হয়ে ভাবতাম, আহা, দ্বারবাসিনীতে ফিরলে মালতীও আমায় এ-রকম বলত। কিন্তু সময়ের বিচিত্ৰ লীলা । এ সম্পর্কে মালতীর কথা আমার মনেই এল না । দু-দিন কামালপুরে রইলাম। হিরন্ময়ী এ কথা ভাবে নি যে, আমি আমার জিনিসপত্র আনতে গিয়েছি ওখানে, সে ভেবেছিল আমি আবার পাঠশালা খুলব। ওখানেই থাকব। 'এবার কিন্তু সে আসবার সময় তর্ক, ঝগড়া করলে না, যেমন ক’রে থাকে। শুধু শুকনো মুখে এসে দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখল আমার যাওয়া । ওর সে আগেকার ছেলেমানুষি যেন চলে গিয়ে একটু অন্য রকম হয়েছে। তবুও কত অনুরোধ করলে ওখানে থাকবার জন্যে-গী এখন ভাল হয়ে গিয়েছে, কেন আমি যাচ্ছি, গায়ের ছেলের! তবে পড়বে কোথায় ? কামালপুর গা পিছু ফেলেছি, মাঠের রাস্তা, গরুর গাড়ি আস্তে আস্তে চলেছে। কি মন খারাপ যে ইয়ে গেল ! মাঠের মধ্যে কচি মটর-শাক, খেসার-শাকের শ্যামল সৌন্দৰ্য্য, শিরীষগাছের কঁচা শুটি ঝুলছে, বাসুদেবপুরের মরগাঙের ভাগাড়ে নতুন ঘাসের ওপর গরুর দল চ’রে বেড়াচ্ছে। হিরন্মগ্নীর নিরাশার দৃষ্টি বুকে যেন কোথায় বিধে রয়েছে, খচখচ ক’রে বাজছে । বেলা যায়-স্যায়, চাকদার বাজার থেকে গুড়ের গাড়ির সারি ফিরছে, বোধ হয় বেলে কি চুয়াডাঙ্গার বাজারে রাত কাটাবে। জীবনটা কি যেন হয়ে গেল, এক ভাবি আর হয়, কোথায় চলেছি। আমিই জানি নে । কেনই বা অপরের মনে এত কষ্ট দিই ? এই রাঙা রোদমাখানো মটর-মুসুরির মঠ যেন বটেশ্বরনাথের দিনগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়। এই সন্ধ্যায় গঙ্গার বুকে বড় বড় পাল তুলে নৌকোর সারি মুঙ্গেবের দিকে যেত, আমি মালতীর স্বপ্নে বিভোর হয়ে পাষাণ-বাধানো ঘাটের ওপর বসে বসে অন্যমনস্ক হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখতুম। সব মিথ্যে, সব স্বপ্ন। ঐ মরগাঙের ওপারে জমা সন্ধ্যাবি কুয়াশার মত-ফাকা, দু-দিনের জিনিস । এখানে ফল পাকে না । জেরুসালেম পাথরের দেশ । এর কিছুদিন পরে হিরন্ময়ীর বাবা আমার কাছে এলেন কালীগঞ্জে। আমায় একবার তাদের ওখানে যেতে হবে, হিরন্ময়ী বিশেষ ক’রে বলে দিয়েছে। আর একটা কথা, মেয়ের বিয়ে নিয়ে তিনি বড় বিপদে পড়েছেন । তিনি গরীব, অবস্থা আমি সবই জানি, গ্রামের সমাজে একঘরেও বটে। দু-তিন জায়গা থেকে সম্বন্ধ এসেছিল, নানা কানাযুষে শুনে তারা পেছিয়ে গিয়েছে । মেয়েও বেজায় একগুয়ে, তাকে দেখতে আসছে শুনলেই সে বাড়ি থেকে পালায়। অত বড় মেয়ে, এখনও জ্ঞান-কাণ্ড হ’ল না, চিরকাল কি ছেলেমানুষি করলে মানায় ? V দৃষ্টি-প্ৰদীপ-১৩