পাতা:দেনা পাওনা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৪২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

দিতে পেরেছিল, তাকে অবিশ্বাস করা যায় কি করে? ব্যাস, যা-কিছু ছিল সমস্ত দিলে চোখ বুজে আমার হাতে তুলে। প্রফুল্ল, দুনিয়ার ভয়ানক চালাক লোকও মাঝে মাঝে মারাত্মক ভুল করে বসে, নইলে সংসার একেবারে মরুভূমি হয়ে দাঁড়াতো, কোথাও রসের বাষ্পটুকু জমবার ঠাঁই পেত না।

 প্রফুল্ল ঘাড় নাড়িয়া কহিল, অতিশয় খাঁটি কথা দাদা। অতএব অবিলম্বে খাতাখানা পড়িয়ে ফেলুন, তারাদাস ঠাকুরকে ডেকে ধমক দিন―জমানো মোহরগুলোয় যদি সলোমন সাহেবের দেনাটা শোধা যায় ত, শব্দ রসের বাষ্প কেন, মুষলধারে বর্ষণ শুরু হতে পারবে।

 জীবানন্দ কহিল, প্রফল্ল এই জন্যেই তোমাকে এত পছন্দ করি।

 প্রফুল্ল হাত জোড় করিয়া বলিল, এই পছন্দটা এইবার একটু খাটো করতে হবে দাদা। রসের উৎস আপনার অফুরন্ত হোক, কিন্তু মোসাহেবি করে এ অধীনের গলার চুঙ্গি পর্যন্ত কাঠ হয়ে গেল, এইবার একবার বাইরে গিয়ে দুটো ডালভাতের জোগাড় করতে হবে। কাল-পরশু আমি বিদায় নিলাম।

 জীবানন্দ হাসিয়া কহিল, একেবারে নিলে? কিন্তু এইবার নিয়ে ক’বার নেওয়া হ’লো প্রফুল্ল?

 বার-চারেক। এই বলিয়া সে নিজেও হাসিয়া ফেলিয়া কহিল, ভগবান মুখটা দিয়েছিলেন, তা বড়লোকের প্রসাদ খেয়েই দিন গেল; দুটো বড় কথাও যদি না মাঝে মাঝে বার করতে পারি নিতান্তই এর জাত যায়। নেহাত অপরাধও নেই দাদা। বহুকাল ধরে আপনাদের জলকে কখনো উঁচু কখনো নিচু বলে এ দেহটায় মেদ মাংসই কেবল শ্রীবৃদ্ধিলাভ করেচে, সত্যিকারের রক্ত বলতে বোধ করি ছিটেফোঁটাও আর বাকী নেই। আজ ভাবছি এক কাজ করব। সন্ধ্যার আবছায়ায় গা-ঢাকা দিয়ে খপ্ করে ভৈরবী ঠাকরুনের এক খামচা পায়ের ধূলো নিয়ে গিলে ফেলব। আপনার অনেক ভালমন্দ দ্রব্যই ত আজ পর্যন্ত উদরস্ত করেচি, এ নইলে সেগুলা আর হজম হবে না, পেটে লোহার মত ফুটবে।

 জীবানন্দ হাসিবার চেষ্টা করিয়া কহিল, আজ উচ্ছ্বাসের কিছু বাড়াবাড়ি হচ্ছে প্রফুল্ল।

 প্রফুল্ল পুনশ্চ হাত জোড় করিয়া কহিল, তাহলে বসুন দাদা, এটা শেষ করি। মোসাহেব-পেন্সন বলে সেদিন যে উইলখানায় হাজার-পাঁচেক টাকা লিখে রেখেচেন, সেটার ওপরে দয়া করে একটা কলমের আঁচড় দিয়ে রাখবেন―চণ্ডীর টাকাটা হাতে এলে মোসাহেবের অভাব হবে না, কিন্তু আমাকে দান করে অতগলো টাকার আর দুর্গতি করবেন না।

 জীবানন্দ কহিল, তাহলে এবার আমাকে তুমি সত্যি সত্যিই ছাড়লে?

 প্রফুল্ল তেমনি করজোড়ে কহিল, আশীর্বাদ করুন, এই সুমতিটুকু শেষ পর্যন্ত যেন বজায় থাকে।

 জীবানন্দ মৌন হইয়া রহিল!

১৪২