পাতা:দেনা পাওনা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৫৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 জীবানন্দ নিজের কথায় লজ্জাবোধ করিয়া কহিল, বেশী না খেলে বোধ হয় ক্ষতি হবে না।

 ষোড়শী বলিল, বোধ হয়। বোধ হয় নিয়ে আপনাদের চলে, কিন্তু আমাদের চলে না।

 কিন্তু এর জন্য ত তোমার দুঃখ হবে।

 ষোড়শী চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া কহিল, দুঃখ হবে কি গো? যাবার সময় তোমার মুখের খাবার কেড়ে নিয়েচি, কিচ্ছু দিতে পারিনি―আমি তো কেঁদেই মরে যাবো! একটু মৌন থাকিয়া হঠাৎ ভারী একটা অনুনয়ের স্বরে বলিয়া উঠিল, ওবেলা নানা ঝঞ্ঝাটে রাঁধতে পারিনি, এবেলা সন্ধ্যার পর রেঁধেছি। ভাত, মাছের ঝোল―

 মাছের ঝোল কি-রকম?

 ষোড়শী হাসিয়া কহিল, কেন, আমি কি বিধবা নাকি? আমি ত সব খাই।

 এতক্ষণ পরে জীবানন্দ হাসিল, বলিল, তা হলে সেগুলি সব নিজের জন্যে রেখে আমাকে দয়া করে ফলার খাওয়াতে গেলে কেন?

 ষোড়শী তৎক্ষণাৎ কহিল, আমার দোষ হয়েচে, অপরাধ হয়েছে―একশ’বার ঘাট স্বীকার করচি। যদি বলেন ত আপনার কাছে আমি দশ হাত মেপে নাকে খত দিতে পারি। এই বলিয়া সে ভিজা-চিড়ার পাতাটা তুলিয়া ভাত ও মাছের ঝোল আনিতে হাসিমুখে উঠিয়া গেল।

 ষোড়শীর প্রশ্নের উত্তরে জীবানন্দ যখন বলিয়াছিল, তাহার ভাবনা আদি-অন্ত নাই, তখন সে মিথ্যা বলে নাই, বোধ করি বাড়াইয়াও বলে নাই। এ জীবনে নিজের জীবনকে সে কখনও আলোচনার বিষয় করে নাই, এবং কোনদিন কোন প্রয়োজনই তাহার মুহূর্তের প্রয়োজনকে অতিক্রম করিয়া যাইতে পায় নাই। তাই তাহার ক্ষণকালের রুমালের প্রয়োজন ক্ষণপরের ঢাকাই চাদরের ঢের বড়; তাই আস্তরণের অভাবে শয্যায় তাহার বহুমূল্য শাল পাতা, এইজন্যই সে হাতের কাছে অ্যাশ-ট্রে না পাইলে সোনার ঘড়ির ডালার উপরে জ্বলন্ত চুরুট রাখিতে লেশমাত্র ইতঃস্তত করে না। ভবিষাৎ তাহার কাছে সত্যবস্তু নয়, যে আসে নাই, সেই অনাগতের প্রতি সে ভ্রূক্ষেপমাত্র করে না! নারীর যে দেহটা সে চোখে দেখিতে পায়, তাহারই প্রতি তাহার আসক্তি, কিন্তু চোখ মেলিয়া যাহাকে দেখা যায় না, সেই তাহার দেহের অতিরিক্ত যে নারীত্ব―তাহার প্রতি তাহার কোন লোভই ছিল না। কিন্তু গ্রহবশে যৌবনের একান্তে আসিয়া আজ যে গহনে সে পথ ভুলিয়াছে ইহার কোন সন্ধানই সে জানিত না। কিসের জন্য যে অলকার আশেপাশে মন তাহার অহর্নিশি ঘুরিয়া মরিতেছে, নানাবিধ কৃচ্ছ্রসাধনায় যৌবন যাহার ক্ষুব্ধ নিপীড়িত, রূপ যাহার কঠিন ও কান্তিহীন, তাহাকে অনুক্ষণ কামনা করিয়া সংসার যখন তাহার এমনি বিস্বাদ হইয়া গেল, তখন কারণাতীত এই মোহের কৈফিয়ৎ সে যে নিজের কাছে খুঁজিয়া পাইত না। কোন্‌ অবিদ্যমানে এই রমণী যে তাহার কোন অপূর্ণতা সম্পূর্ণ করিয়া দিবে, কি তাহার প্রয়োজন, এই অপরিচিত চিন্তার সে কুল পাইত না।

১৫৬