পাতা:দেনা পাওনা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৬৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 এককড়ি কহিল, ছোটলোক ব্যাটাদের বুদ্ধি এবং টাকা কে জুগিয়েছে জানতে পারলাম না; কিন্তু এটুকু জানতে পারলাম তারা সাক্ষী মানলে হুজুর গোপন কিছুই করবেন না। দলিল তৈরির কথা পর্যন্ত না।

 জনার্দনের মুখ ফ্যাকাশে হইয়া গেল। লোকটার একগুঁয়েমির যে ভয়ানক ইতিহাস সেদিন শুনাইয়াছিলেন তাহা স্মরণ হইল। তাঁহার মুখ দিয়া শুধু বাহির হইল―এ কি লঙ্কাকাণ্ড করবে নাকি শেষে!

 সাজা তামাক তাঁহার পুড়িতে লাগিল, স্নানের জল ঠাণ্ডা হইতে লাগিল, জনার্দন ছুটিয়া বাহির হইয়া গেলেন। জীবানন্দ তখন মন্দিরের একটা ভাঙ্গা খিলান পরীক্ষা করিতেছিলেন এবং তারাদাস অদূরে দাঁড়াইয়া তাঁহার প্রশ্নের জবাব দিতেছিল জনার্দন একেবারে সম্মুখে উপস্থিত হইয়া বলিলেন, হুজুর। সমস্ত ব্যাপার একবার মনে করে দেখুন।

 জীবানন্দ প্রথমে বুঝিতে পারিলেন না কিসের ব্যাপার, কিন্তু তাহার অস্বাভাবিক ব্যাকুলতা এবং প্রাঙ্গণের একধারে এককড়ি নন্দীকে দেখিতে পাইয়া কাল রাত্রের কথা স্মরণ হইল। বলিলেন, কিন্তু উপায় কি রায়মশাই? সাহেব জমি ছাড়তে চায় না সে সস্তায় কিনেচে―তাছাড়া তার বিস্তর ক্ষতিও হবে। সুতরাং মকদ্দমা জেতা ছাড়া প্রজাদের আর ত পথ দেখিনে।

 জনার্দন আকুল হইয়া কহিলেন, কিন্তু আমাদের পথ?

 জীবানন্দ ক্ষণকাল চিন্তা করিয়া কহিলেন, সে ঠিক, আমাদের পথও খুব দুর্গম মনে হয়।

 তাঁহার শান্তকণ্ঠ ও নির্বিকার মুখের ভাব দেখিয়া জনার্দন নিজেকে আর সামলাইতে পারিলেন না। মরিয়া হইয়া বলিয়া উঠিলেন, হুজুর, পথ শুধু দুর্গম নয়―জেল খাটতে হবে। এবং আমরা একা নয়, আপনিও হয়ত বাদ যাবেন না।

 জীবানন্দ একটুখানি হাসিলেন, বলিলেন, তাই বা কি করা যাবে রায়মশাই? সখ করে যখন গাছ পোঁতা গেছে, তখন তার ফল খেতেই হবে বৈ কি।

 জনার্দন আর জবাব দিলেন না। ঝড়ের বেগে বাহির হইয়া গেলেন। এককড়ি সব কথা বোধ হয় শুনিতে পায় নাই, সে দ্রুতপদে কাছে আসিতেই তাহাকে চীৎকার করিয়া বলিলেন, এ আমাদের সর্বনাশ করবে এককড়ি, আমার নির্মলকে একটা টেলিগ্রাফ করে দাও―সে একবার এসে পড়ুক।

সাতাশ

 চণ্ডীগড় হইতে নির্মল অনেক দুঃখ পাইয়াই গিয়াছিল। ইহার ভাল এবং সকল সংস্রব হইতে নিজেকে সে চিরকালের মত বিযুক্ত করিয়া যাইতেছে, যাইবার সময়ে ইহাই ছিল তাহার একান্ত অভিলাষ। ভগবানের কাছে কায়মনে প্রার্থনা করিয়াছিল, যাহা গত হইয়াছে তাহা যেন আর ফিরিয়া না আসে, ইহার কোন প্রয়োগসূত্রই আর যেন না জীবনে তাহার কোথাও অবশিষ্ট রহিয়া যায়। সে সোজা মানুষ। বিলাস

১৬৬