পাতা:দেনা পাওনা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৩৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

তাহার উদ্যত বিপদ-সম্বন্ধে পুরোহিত বেচারার বোধহয় কিছু আভাস দিবার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু ভৈরবীর মুখের প্রতি চাহিয়া তাহার কোন কথাই মুখে আসিল না।

 আজ মন্দির-প্রাঙ্গণের বড় দ্বার খোলা। প্রবেশ করিতেই দেখিতে পাইল ওধারের দেয়ালের গায়ে গোটা-দুই কালো রঙের পাঁঠা বাঁধা আছে, এবং বারান্দার একপ্রান্তে পূজার উপকরণ ভারে ভারে স্তূপাকার করা হইয়াছে। তথায় পাঁচ-ছয়জন বর্ষীয়সী রমণী বাক্যে এবং কার্যে অত্যন্ত ব্যস্ত হইয়া আছেন, এবং সর্বাপেক্ষা প্রচণ্ড কলরব উঠিয়াছে প্রাঙ্গণের নাটমন্দিরের মধ্যে। সেখানে রায়মহাশয়ের সুদৃশ্য এবং প্রশস্ত সতরঞ্চি বিছানো রহিয়াছে, এবং তাহাকে মধ্যবর্তী করিয়া গ্রামের প্রবীণের দল যথাযোগ্য মর্যাদায় আসীন হইয়া সম্ভবত বিচার করিতেছে এবং তাহা ষোড়শীকে লইয়া। এতক্ষণ কে শুনিতেছিল বলা যায় না, অথচ আশ্চর্য এই যে, যাহার শোনা সবচেয়ে প্রয়োজন, সে কাছে আসিয়া দাঁড়াতেই এই শতকণ্ঠের উদ্দাম বক্তৃতা একেবারে পলকে নিবিয়া গেল।

 কিছুক্ষণ পর্যন্ত কোন পক্ষ হইতেই কোন প্রসঙ্গ উত্থাপিত হইল না। পুরুষেরা সকলেই ষোড়শীর পরিচিত, এবং মেয়েরাও যখন কাজ ফেলিয়া একে একে থামের আড়ালে আসিয়া দাঁড়াইল, তাহারাও তাহার পরিচিত নয়; কেবল যে মেয়েটি সকলের পরে মন্দিরের মধ্য হইতে বাহির হইয়া ধীরে ধীরে আসিয়া ঠিক তাহার সম্মুখে জোড়া-থামটা আশ্রয় করিয়া নিঃশব্দে দাঁড়াইয়া তাহার প্রতি একদৃষ্টে চাহিয়া রহিল সে অচেনা হইলেও ষোড়শী একমুহূর্তে বুঝিল, এই হৈমবতী। এই মেয়েটি তাহার স্বামীগৃহ ছাড়িয়া বহুকাল যাবৎ বাপের বাড়ি আসিতে পারে তাই; তাই তাহার সম্বন্ধে জনশ্রুতিও এই বাপের বাড়ির দেশে উত্তরোত্তর বিবিধ হইয়াই উঠিতেছিল? সে অখাদ্য খানা খায়, ঘাগরা এবং জুতো-মোজা পরে, রাস্তায় পুরুষদের হাত ধরিয়া বেড়ায়, সে একেবারে খ্রীষ্টান মেমসাহেব হইয়া গেছে―এমন কত কি! আজ কিন্তু ষোড়শী তাহার কিছুই দেখিতে পাইল না। পরনে একখানি মূল্যবান বেনারসি শাড়ি এবং গায়ে দু-খানা দামী অলঙ্কার ব্যতীত, জুতা-মোজা-ঘাগরার কিছুই ছিল না। বরঞ্চ তাহার সিঁথির সিঁদুর এবং পায়ের আলতা বেশ মোটা করিয়াই দেওয়া, দেখিতে কোনমতেই মনে হয় না এ-সকল সে বিশেষ করিয়া কেবল আজিকার জন্যই ধারণ করিয়া আসিয়াছে। সে সুন্দরী সত্য, কিন্তু অসাধারণ নয়। দেহের রঙটা হয়ত একটু ময়লার দিকেই, তবে ধনী-ঘরের মেয়েরা যেমন নিরন্তর মাজিয়া-ঘষিয়া বর্ণটাকে উজ্জ্বল করিয়া তোলে ইহাও তেমনি―তাহার অধিক নয়। নিমেষের দৃষ্টিপাতেই ষোড়শীর মনে হইল এই ধনী-গৃহিনী ধনের আড়ম্বরেও যেমন তাহার দেহকে বস্ত্রালঙ্কারের দোকান করিয়া সাজায় নাই, লজ্জা এবং নির্লজ্জতা কোনটার বাড়াবাড়িতেও তেমনি তাহার শিশুকালের গ্রামখানিকে বিড়ম্বিত করিয়া তোলে নাই। মেয়েটি নীরবে চাহিয়া রহিল, হয়ত শেষ পর্যন্ত এমনি নীরবেই রহিবে, কিন্তু ইহারই সম্মুখে নিজের আসন্ন দুর্গতির আশঙ্কায় ষোড়শীর লজ্জায় ঘাড় হেঁট হইয়া গেল।

 আরও মিনিট দুই-তিন নিঃশব্দে কাটিয়া গেলে বৃদ্ধ সর্বেশ্বর শিরোমণি প্রথমে

৩৮