পাতা:দেনা পাওনা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৮০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 এবার রায়মহাশয় মুখ তুলিয়া চাহিলেন; বলিলেন, নন্দীমশাই ত সমস্ত জানেন, তিনি কি হুজুরের গোচর করেন নি?

 জীবানন্দ কহিলেন, হয়ত করেছেন, কিন্তু আমার মনে নেই। তা ছাড়া, তার গোচর করার প্রতি বেশি আস্থা না রেখে ব্যাপারটা আপনারাই বলুন। দ্বিরুক্তি দোষ ঘটতে পারে, কিন্তু কি আর করা যাবে। জমিদারের গোমস্তা―একটা মোকাবিলা হয়ে থাকা ভাল। ঠিক না?

 প্রভুর মুখে এককড়ির এই সুখ্যাতিটুকুকে রায়মহাশয় মনে মনে আনন্দ লাভ করিলেন। কিন্তু চাঞ্চল্য প্রকাশ না করিয়া পরম গাম্ভীর্যের সহিত বলিলেন, হুজুর সর্বজ্ঞ। ভৃত্যের সম্বন্ধে যথা ইচ্ছা আদেশ করতে পারেন, কিন্তু আমাদের অভিযোগ―

 কি অভিযোগ?

 জনার্দন রায় কহিলেন, আমরা গ্রামস্থ ষোল আনা ইতর-ভদ্র একত্র হয়ে―

 জীবানন্দ একটু হাসিয়া বলিলেন, তা দেখতে পাচ্চি। ওইটি কি সেই ভৈরবীর বাপ তারাদাস ঠাকুর নয়? এই বলিয়া তিনি তাহার প্রতি অঙ্গুলিসঙ্কেত করিলেন।

 তারাদাস সাড়া দিল না, জাজিমটার অংশবিশেষের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া নিঃশব্দে বসিয়া রহিল, এবং রায়মহাশয়ের আনত মুখের ’পরেও একটা ফ্যাকাশে ছায়া পড়িল। কিন্তু মুখরক্ষা করিলেন শিরোমণিঠাকুর। তিনি সবিনয়ে কহিলেন, রাজার কাছে প্রজা সন্তানতুল্য, তা দোষ করিলেও সন্তান, না করলেও সন্তান। আর কথাটা একরকম ওরই। ওর কন্যা ষোড়শী সম্বন্ধে আমরা নিশ্চয় স্থির করেছি, তাকে আর মহাদেবীর ভৈরবী রাখা যেতে পারে না। আমাদের নিবেদন, হুজুর তাকে সেবায়েতের কাজ থেকে অব্যাহতি দেবার আদেশ করুন।

 জমিদার চকিত হইয়া উঠিলেন, কহিলেন, কেন? তার অপরাধ?

 দুই-তিনজন প্রায় সমস্বরে জবাব দিয়া ফেলিল, অপরাধ নিরতিশয় গুরুতর।

 জীবানন্দ একে একে তাহাদের মুখের দিকে চাহিয়া অবশেষে জনার্দনের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া কহিলেন, তিনি হঠাৎ এমন কি ভয়ানক দোষ করেচেন রায়মহাশয়, যার জন্য তাঁকে তাড়ানো আবশ্যক?

 জনার্দন মুখ তুলিয়া শিরোমণিকে চোখের ইঙ্গিত করিতেই জীবানন্দ বাধা দিয়া কহিলেন, না, না, উনি অনেক পরিশ্রম করেচেন, বুড়োমানুষকে আর কষ্ট দিয়ে কাজ নেই, ব্যাপারটা আপনিই ব্যক্ত করুন।

 রায়মহাশয়ের চোখে ও মুখে দ্বিধা ও অত্যন্ত সঙ্কোচ প্রকাশ পাইল, মৃদুকণ্ঠে কহিলেন, ব্রাহ্মণকণ্যা―এ আদেশ আমাকে করবেন না।

 জীবানন্দ হাসিমুখে কহিলেন, দেব-দ্বিজে আপনার অচলা ভক্তির কথা এদিকে কারও অবিদিত নেই। কিন্তু এতগুলি ইতর-ভদ্রকে নিয়ে আপনি নিজে যখন উপস্থিত হয়েচেন তখন ব্যাপার যে অতিশয় গুরুতর তা আমার বিশ্বাস হয়েচে। কিন্তু সেটা আপনার মুখ থেকেই শুনতে চাই।

৮০