পাতা:নরওয়ে ভ্রমণ.pdf/৫৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
নরওয়ে ভ্রমণ
৫১

তরতর করিয়া নামিয়া আসিয়া, একেবারে কৃষকের আঙ্গিনায় পড়িতেছে। বুঝিলাম যে, উপরে লোক থাকিয়া এ কার্য্য করিতেছে। ঘন বন এবং উঁচু বলিয়া উহাদিগকে দেখা যাইতেছে না। জঙ্গল সাফ হইয়া, এই কৌশলে অতি অল্প সময়ের মধ্যে, অনেক বোঝা নীচে জড় হইতেছে। শুনিলাম, এই সকল লতাপাতা রৌদ্রে শুকাইয়া গৃহপালিত পশুদিগের শীতের খাদ্য ও শয্যার নিমিত্ত, আর ডালপালাগুলি নিজেদের ইন্ধন স্বরূপ ব্যবহৃত হইবে। দেখিলাম, কিছু শুকানো হইয়া গিয়াছে, কিছু কিছু বাড়ীর চারিদিকের বেড়ার উপর ঝুলানো রহিয়াছে, অবশিষ্টগুলি মাটিতে ছড়ানো সময়মত ঘরে পুঞ্জীকৃত করিয়া রাখা হইবে। আহা! শীতের দেশের দীনদুখীর কষ্ট আমরা কল্পনাই করিতে পারি না। কত গৃহহীন অনাথা নাকি পথের ধারে পড়িয়া, শীতে রক্ত জমাট হইয়া মরিয়া থাকে। কাহারও যদি বা মাথা রাখিবার স্থান থাকে, তবুও আগুনের অভাবে প্রাণ বিসর্জ্জন দিতে হয়। কত লোক খড়কুটার উপরে শুইয়া রাত কাটায়। সেও একদিন দুইদিন নয়, ক্রমাগত আট মাস, অর্থাৎ যত দিন বরফ পড়া ক্ষান্ত না হয়। ততদিন খাওয়া-পরারই বা কি হাল শুনি। অনেকের ভাগ্যে শুধু সিদ্ধ আলু আর নুন, তাও নাকি রোজ জোটে না। শিকারের শুষ্ক মাংস সঞ্চিত রাখিবার মত স্থানই বা তাদের কোথায়? এই কারণে, এই সব শীতপ্রধান দেশে, অনেক শিশু ও বৃদ্ধ প্রতি বৎসর মারা যায়। বয়স্কেরা আপন আপন শরীরের রক্তের জোরে যা বাঁচিয়া যায়। এতদিন এ সব শোনা-কথায় বিশ্বাস করি নাই, আজ স্বচক্ষে ইহাদের ঘরবাড়ী আসবাব দেখিয়া, দারুণ শীতের প্রকোপে ইহাদের ভবিষ্যৎ দুর্দ্দশা যেন প্রত্যক্ষ করিলাম। বেলা পড়িলে জাহাজে ফিরিবার মুখে, নিকটবর্ত্তী এক হোটেলে চায়ের উদ্দেশে প্রবেশ করা গেল। গিয়া দেখি, সেখানে আজ মহা ধুমধাম চলিয়াছে। সেই জর্ম্মনীর রাজা, আজ তাঁহার জাহাজের সকল কর্ম্মচারীরিগের এখানে রাত্রি-ভোজের বন্দোবস্ত করিতে আদেশ দিয়াছেন। আহারের স্থানসকল শোভনরূপে সজ্জিত করা হইয়াছে বলিয়া, হোটেলের কর্ত্তৃপক্ষগণ, আজ আগন্তুকদিগের জন্য আলাদা ঘরের বন্দোবস্ত করিয়াছেন। সে সব ঘর একেবারে ভরপুর দেখিয়া, আমরা খোলা বারান্দায় আসিয়া কোন প্রকারে একটু বসিবার স্থান যোগাড় করিয়া লইলাম। আমরা জানি, বিলাতের হোটেলের মত দশটা লোক তৎক্ষণাৎ আসিয়া, আমাদের আজ্ঞার অপেক্ষা করিবে। কিন্তু তাহার কোন চিহ্নই দেখিলাম না। বস্ বসিয়াই আছি। এতদিন কুক্ কোম্পানীর তত্ত্বাবধানে এ সব ঝঞ্ঝাটে কখনও পড়িতে হয় নাই।