পারিলেন—রমণী তাঁহার স্বর্গবাসিনী পুণ্যবতী জননী। ডড্লে ‘মা মা’ বলিয়া কাঁদিয়া উঠিলেন, তাঁহার মুদিত নেত্রের প্রান্তে অশ্রুর উৎস উৎসারিত হইল। পাছে সেই মূর্ত্তি মুহূর্ত্তে অদৃশ্য হয়—এই ভয়ে তিনি চক্ষু মেলিয়া চাহিতে পারিলেন না। রমণী ধীরে ধীরে তাঁহার মাথায় হাত বুলাইয়া কোমল কণ্ঠে বলিলেন, “ভয় কি বাছা।—আমি তোমাকে রক্ষা করিতে আসিয়াছি। বিপদ হইতে তোমাকে উদ্ধার করিব,—তুমি নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাও।”—ডড্লে বিকারঘোরে ঘুমাইয়া পড়িলেন। তাঁহার সকল জ্বালা যন্ত্রণা বেদনা অন্তর্হিত হইল।
পরদিন যখন তিনি চক্ষু খুলিলেন, তখন দেখিতে পাইলেন, তাঁহার হস্তপদ আর রজ্জুবদ্ধ নহে, বন্ধন অপসারিত হইয়াছে। তিনি যে নৌকায় নিপতিত ছিলেন, সেই নৌকাখানিও আর দেখিতে পাইলেন না। তাঁহার বোধ হইল, তিনি একখানি বৃহৎ জাহাজে স্থূল ক্যাম্বিসের শয্যায় শায়িত রহিয়াছেন। এ কি স্বপ্ন, না সত্য? তিনি চাহিয়া চাহিয়া দেখিলেন জাহাজের মাঝি মাল্লারা তাঁহার চারিদিকে নানা কার্য্যে বাস্তভাবে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। স্টীমারের ঘসঘস শব্দ তাঁহার শ্রবণবিবরে প্রবেশ করিতেছে। জাহাজের মেট এক একবার উচ্চৈঃস্বরে নাবিকদিগকে আদেশ করিতেছিল—তাহাও তিনি শুনিতে পাইলেন, তখন আর তিনি ইহা স্বপ্ন বলিয়া মনে করিতে পারিলেন না। তিনি আকুলদৃষ্টিতে চারিদিকে চাহিতে লাগিলেন। তাঁহাকে জাগরিত দেখিয়া একজন নাবিক উচ্চৈঃস্বরে কাহাকে কি বলিল, তাহা শুনিয়া শুভ্রবেশধারী একজন পাচক এক পেয়ালা ব্রথ্ একখানি চাম্চে দিয়া নাড়িতে-নাড়িতে তাঁহার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল, এবং কোমলস্বরে বলিল, “কিহে খোদার পোলা, তুমি যে জাগিয়াছ দেখিতেছি। কেমন আছ? বড় কাবু হইয়াছ, নয়?—আচ্ছা উঠিয়া বসিয়া এই ব্রথ্টুকু খাইয়া ফেল দেখি।—ওহো, তুমি বড়ই দুর্ব্বল, তোমার ভাব দেখিয়া বোধ হইতেছে উঠিতে পারিবে না। তা, না পার ক্ষতি নাই, তুমি একটু মাথা তুলিয়া হাঁ কর, আমি এই চাম্চে দিয়া এক-একটু করিয়া খাওয়াইয়া দিতেছি।”