পাতা:নারীর মূল্য-শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.djvu/১৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
নারীর মূল্য
১২

পরলোকে একসঙ্গে বাস করে—এ-কথা স্বীকার করা আমার পক্ষে কঠিন।

 লেকি সাহেব লিখিয়াছেন, এই প্রথা ইংরাজেরা যখন তুলিয়া দেন, তখন টোলের পণ্ডিত-সমাজ চেঁচামেচি করিয়া, সভা-সমিতি করিয়া, রাজা-রাজড়ার নিকট চাঁদা তুলিয়া বিলাত পর্যন্ত আপীল করিয়াছিল। তাহাতে বলা হইয়াছিল, এ-প্রথা নিষিদ্ধ হইয়া গেলে হিন্দু-ধর্ম বনিয়াদসমেত বসিয়া হিন্দু একেবারে ধর্মচ্যুত হইয়া যাইবে। নারী-পূজা বটে!

 তারপর আপীল যখন নিতান্তই না-মঞ্জুর হইয়া গেল, এবং বেশ বুঝা গেল, অতঃপর ঢাক ঢোল কাঁসি শাঁখের শব্দে পিয়াদার কান ঢাকা পড়িবে না, এবং ধূনা পোড়াইয়া সমস্ত নদীর কিনারাটা অন্ধকার করিয়া ফেলিলেও দারোগার দৃষ্টি এড়াইবে না, তখন ধর্মধ্বজেরও বুঝিতে বিলম্ব হইল না যে, সনাতন হিন্দুধর্মের বনিয়াদ ইঞ্চি কয়েক বসিয়া গেলেও যদি বা চলে, পুলিশের হাঙ্গামায় পড়িলে চলিবে না। সুতরাং অন্য পথের সন্ধান দেখিতে হইল। রাজার কাজ রাজা করিয়া গেলেন, কিন্তু সমাজ-রক্ষকের কাজ বাড়িয়া গেল। এ-দুর্দিনে বসিয়া পড়িলে চলিবে না। তাঁহারা কহিলেন, ম্লেচ্ছ আমাদের ধর্ম বুঝিল না—আইন করিয়া বসিল; আমরা কিন্তু হাল ছাড়িব না। এইখানে বসিয়াই আমাদের বিধবাকে দেবী বানাইয়া তুলিব। তাহার পর শাস্ত্রের পুরাতন শ্লোক এতদিন যাহা অব্যবহারে কোথায় পড়িয়াছিল, তাহাই টানিয়া বাহির করিয়া, লোকাচারের দেহাই দিয়া, সুনীতির দোহাই দিয়া, যত রকমের কঠোরতা কল্পনা করা যাইতে পারে, সমস্তই সদ্য-বিধবার মাথায় তুলিয়া দিয়া, তাহাকে প্রত্যহ একটু একটু করিয়া দেরী করা হইতে লাগিল। সে নিরাভরণা, সে একবেলা খায়, সে হাড়ভাঙা খাটুনি খাটে, থান-ফাড়া কাপড় পরে, কেন-না সে দেবী। চীৎকার করিয়া পুরুষ প্রচার করিতে লাগিল, আমাদের বিধবার মত কাহার সমাজে এমন দেবী আছে! অথচ দেবীটিকে