পাতা:নারীর মূল্য-শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.djvu/৬০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৫৯
নারীর মূল্য

তাহাদের জিনিস তাহারা যদৃচ্ছ বেচিবে-কিনিবে—সে-মূল্য ধার্য করিয়া দিবার মালিক তাহারা ছাড়া আর কেহ নাই। এই অহঙ্কারে মানুষ প্রায় শতাব্দীকাল পর্যন্ত এই সত্যকে অস্বীকার করিয়াই চলিয়াছিল। এখনই যে সকলে একবাক্যে মানিয়া লইয়াছে তাহা বলি না, কিন্তু যাহারা মানিয়াছে তাহারা এটা বেশ দেখিতে পাইয়াছে, এই অস্বাভাবিক নিয়ম লঙ্ঘন করিয়া চলিলে শেষ পর্যন্ত কিছুতেই সুফল ফলে না—তাহাদেরও না, আর পাঁচ জনেরও না, ধান-চালের বাজারেও না, ছেলে-মেয়ে বেচাবেচির বাজারেও না। এই অন্ধতার একটা জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত, গায়ের জোরে দাম বাড়ানোর একটা জীবন্ত সাক্ষী আমাদের দেশের কৌলীন্য বংশগত করাটা। তা যদি না হইত, তাহা হইলে আজ কুলীন বামুন বলিলে লোকে গালাগালি মনে করিত না। বামুনের ছেলে শ্বশুর-বাড়ী গিয়া পয়সা লইয়া রাত্রিযাপন করে, এবং পরদিন সেই পয়সায় গাঁজা-গুলি খায়, এটা হইতে পারিত না। মানুষ, বিশেষ করিয়া ব্রাহ্মণ-সন্তান, কতটা হীন হইবার পরে তবে যে এই কাজ করিতে সমর্থ হয়, তাহা বুঝাইয়া বলিতে যাওয়াই বাড়াবাড়ি। এই কুলীনের ছেলে কুলীনকে ভ্রান্ত সমাজ যে মূল্য দিতেছিল, সে তাহার যথার্থ প্রাপ্য মূল্য হইলে, কিছুতেই তাহারও এতবড় অবনতি ঘটিত না, সমাজও এমন শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরিয়া অগণিত নিরুপায় বঙ্গ-রমণীর নিষ্পাপ রক্ত সর্বাঙ্গে মাখিয়া, তাহাদের ব্যর্থ জীবনের দীর্ঘশ্বাস ও অভিসম্পাত বহিয়া, ভগবানের কৃপা হইতে বঞ্চিত হইয়া, এমন পঙ্গু এমন মিথ্যা হইয়া পড়িতে পারিত না। আজ বোধ করি কতকটা চক্ষু খুলিয়াছে। যাহার সত্য মূল্য নাই, রাজাজ্ঞাতেই হৌক, বা সমাজের ইচ্ছাতেই হৌক, তাহার মূল্য অযথা বাড়াইয়া তুলিলে পরিণামে মঙ্গল হয় না। এই সত্য অপরদিকেও ঠিক এমনি প্রযুজ্য। যাহার যতটা মূল্য তাহাকে ঠিক ততটা দিতেই হইবে—অজ্ঞানেই হৌক বা অহঙ্কারেই হৌক, বঞ্চিত করিয়া কিছুতেই কল্যাণ লাভ করা যাইবে না। মিথ্যা কখনও জয়ী হইবে না। এই হিসাবে যাচাই করিয়া