পাতা:পঞ্চভূত - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৯৫

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

গদ্য ও পদ্য

করিলেন। তিনি বলিলেন, ‘কৃত্রিমতাই মনুয্যের সর্বপ্রধান গৌরব। মানুষ ছাড়া আর কাহারও কৃত্রিম হইবার অধিকার নাই। গাছকে আপনার পল্লব প্রস্তুত করিতে হয় না, আকাশকে আপনার নীলিমা নির্মাণ করিতে হয় না, ময়ূরের পুচ্ছ প্রকৃতি স্বহস্তে চিত্রিত করিয়া দেন। কেবল মানুষকেই বিধাতা আপনার সৃজনকার্যের অ্যাপ্রেণ্টিস করিয়া দিয়াছেন, তাহার প্রতি ছোটোখাটো সৃষ্টির ভার দিয়াছেন। সেই কার্যে যে যত দক্ষতা দেখাইয়াছে সে তত আদর পাইয়াছে। পদ্য গদ্য অপেক্ষা অধিক কৃত্রিম বটে; তাহাতে মানুষের সৃষ্টি বেশি আছে; তাহাতে বেশি রঙ ফলাইতে হইয়াছে, বেশি যত্ন করিতে হইয়াছে। আমাদের মনের মধ্যে যে বিশ্বকর্মা আছেন, যিনি আমাদের অন্তরের নিভৃত সৃজনকক্ষে বসিয়া নানা গঠন, নানা বিন্যাস, নানা প্রয়াস, নানা প্রকাশ-চেষ্টায় সর্বদা নিযুক্ত আছেন, পদ্যে তাঁহারই নিপুণ হস্তের কারুকার্য অধিক আছে। সেই তাঁহার প্রধান গৌরব। অকৃত্রিম ভাষা জলকল্লোলের, অকৃত্রিম ভাষা পল্লবমর্মরের, কিন্তু মন যেখানে আছে সেখানে বহুযত্নরচিত কৃত্রিম ভাষা।’

 স্রোতস্বিনী অবহিত ছাত্রীর মতো সমীরের সমস্ত কথা শুনিলেন। তাঁহার সুন্দর নম্র মুখের উপর একটা যেন নূতন আলোক আসিয়া পড়িল। অন্য দিন নিজের একটা মত বলিতে যেরূপ ইতস্তত করিতেন, আজ সেরূপ না করিয়া একেবারে আরম্ভ করিলেন, ‘সমীরের কথায় আমার মনে একটা ভাবের উদয় হইয়াছে, আমি ঠিক পরিষ্কার করিয়া বলিতে পারিব কি না জানি না। সৃষ্টির যে অংশের সহিত আমাদের হৃদয়ের যোগ— অর্থাৎ, সৃষ্টির যে অংশ শুদ্ধমাত্র আমাদের মনে জ্ঞান সঞ্চার করে না, হৃদয়ে ভাব সঞ্চার করে, যেমন ফুলের সৌন্দর্য, পর্বতের মহত্ব-সেই অংশে কতই নৈপুণ্য খেলাইতে হইয়াছে, কতই রঙ ফলাইতে, কত

৮৫