পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১০২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

হয়ত ভার আটকায় না। বস্তুতঃ ঘরকন্নার কাজে এর বেশি ভার প্রয়োজন হয় না। আপনি ও গল্প পড়েচেন, কোন্ এক ঋষি-পুত্রের দুধের বদলে চালের গুঁড়োর জল খেয়েই আরামে দিন কাটতো। কিন্তু আরাম যেমনই হোক, যা নয় তাকে তাই বলে গর্ব্ব করা ত যায় না।

 এই আলোচনা অপূর্ব্বর অত্যন্ত বিশ্রী ঠেকিল, কিন্তু এবারেও সে জবাব দিতে না পারিয়া কহিল, আপনি কি বলতে চান এর অধিক কারও ভাগ্যেই জোটে না?

 সুমিত্রা কহিলেন, না, তা আমি বলতেই পারিনে। কারণ, সংসারে দৈবাৎ বলেও একটা শব্দ আছে।

 অপূর্ব্ব কহিল, ওঃ—দৈবাৎ। কিন্তু কথা যদি আপনার সত্যও হয়, তবুও আমি বলি সমাজের মঙ্গলের জন্য, উত্তর পুরুষের কল্যাণের জন্য, আমাদের এই-ই ভাল।

 সুমিত্রা তেমনি শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলিলেন, না অপূর্ব্ববাবু, সমাজ এবং আপনার উত্তর পুরুষ কোনটারই এতে শেষ পর্য্যন্ত কল্যাণ হবে না। সমাজ ও বংশের নাম করে ব্যক্তিকে একদিন বলি দেওয়া হতো, কিন্তু ফল তার ভাল হয় নি;—আজ তা অচল। ভালবাসার সবচেয়ে বড় প্রয়োজন উত্তর পুরুষের জন্য না হলে এমন ভয়ানক স্নেহের ব্যবস্থা তার মাঝখানে স্থান পেত না। এই ব্যর্থ বিবাহিত জীবনের মোহ নারীকে কাটাতেই হবে। তাকে বুঝাতেই হবে, এতে লজ্জাই আছে, গৌরব নেই।

 অপূর্ব্ব ব্যাকুল হইয়া কহিল, কিন্তু ভেবে দেখুন আপনাদের এই সকল শিক্ষায় আমাদের সুনিয়ন্ত্রিত সমাজে অশান্তি এবং বিপ্লর এসেই উপস্থিত হবে।

 সুমিত্রা বলিলেন, হলই বা। অশান্তি এবং বিপ্লব মানেই ত অকল্যাণ নয় অপূর্ব্ববাবু। যে রুগ্ন, জীর্ণ, জরাগ্রস্ত সেই শুধু উৎকণ্ঠিত সতর্কতায় আপনাকে আগলে রাখতে চায়, কোন দিক দিয়ে না তার গায়ে ধাক্কা লাগে। অনুক্ষণ এই ভয়েই সে কাঁটা হয়ে থাকে, এতটুকু নাড়াচাড়াতেই তার প্রাণবায়ু চোখের পলকে বেরিয়ে যাবে। আর এমনি অবস্থাই যদি সমাজের হয়ে থাকে ত যাক্ না একটা হেস্ত-নেস্ত হয়ে। দুদিন আগেপাছের জন্য কি-ই বা এমন ক্ষতি হবে?

 এ-কথার অপূর্ব্ব আর অবাব দিল না, চুপ করিয়া রহিল। সুমিত্রা নিজেও ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া কহিলেন, ঋষি-পুত্রের উপমা দিয়ে হয়তো আপনাকে আমি ব্যথা দিয়েচি। কিন্তু ব্যথা যে আপনার পাওনা ছিল, তার থেকে আপনাকে আমি বাঁচাতামই বা কি করে।

 তাঁর শেষের কথাটা অপূর্ব্ব বুঝিতে পারিল না, কিন্তু বিরক্তির পাত্র তাহার

৯৮