পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১২৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 অপূর্ব্ব কহিল, তা’হলে প্রাসাদ থেকে ভগবান যেন আমাকে চিরদিন বঞ্চিত রাখেন! বাপরে বাপ্!

 ডাক্তার বলিলেন, শুনলাম কার রাত্রে আপনার কষ্ট হয়েচে অপূর্ব্ববাবু, আমাকে ক্ষমা করতে হবে।

 অপূর্ব্ব কহিল, ক্ষমা করব শুধু আপনি এ ঘর ছাড়লে। তার আগে নয়!

 প্রত্যুত্তরে ডাক্তার শুধু একটু হাসিলেন, বলিলেন, আচ্ছা তাই হবে।

 এতক্ষণ অপূর্ব্ব নজর করে নাই, হঠাৎ ভয়ানক আশ্চর্য্য হইয়া দেখিতে পাইল, দেওয়ালের কাছে একটা মোড়ার উপরে বসিয়া সুমিত্রা। আপনি এখানে? আমাকে সাফ করবেন, আমি একেবারে দেখতে পাইনি।

 সুমিত্রা কহিলেন, সে অপরাধ আপনার নয় অপূর্ব্ববাবু, অন্ধকারের।

 অপূর্ব্বর বিস্ময়ের সীমা রহিল না তাহার গলা শুনিয়া। সে কণ্ঠস্বর যেমন করুণ তেমনি বিষণ্ণ। কি একটা ঘটিয়াছে বলিয়া যেন তাহার ভয় করিতে লাগিল। ভাল করিয়া ঠাওর করিয়া আস্তে আস্তে কহিল, ডাক্তারবাবু, এ আপনার আজ কি রকম পোষাক? কোথাও কি বার হচ্ছেন?

 ডাক্তারের মাথায় পাগড়ী, গায়ে লম্বা কোট; পরণে ঢিলা পায়জামা, পায়ে রাওলপিণ্ডির নাগরা, একটা চামড়ার ব্যাগে কি কতকগুলো বাণ্ডিল বাঁধা। কহিলেন, আমি ত এখন চলতি অপূর্ব্ববাবু, এরা সব রইলেন, আপনাকে দেখতে হবে। আপনাকে এর বেশি বলার আমি আবশ্যক মনে করিনে।

 অপূর্ব্ব অবাক হইয়া কহিল, হঠাৎ চলতি কি রকম! কোথায় চলতি?

 এই ডাক্তার লোকটির কণ্ঠস্বরে ত কোন পরিবর্ত্তন হয় না, তেমনি সহজ, শান্ত, স্বাভাবিক গলায় বলিলেন, আমাদের অভিধানে কি ‘হঠাৎ’ শব্দ থাকে অপূর্ব্ববাবু? চলতি সম্প্রতি ভামোর পথে আরও কিছু উত্তরে। কিছু সাঁচ্চা জরির মাল আছে, সিপাইদের কাছে বেশ দামে বিক্রী হয়। এই বলিয়া মুখ টিপিয়া হাসিলেন

 সুমিত্রা এতক্ষণ কথা কহে নাই, সহস্য বলিয়া উঠিল, তাদের পেশোয়ার থেকে একেবায়ে ভামোয় সরিয়ে এনেচে, তুমি জানো তাদের ওপর কি রকম কড়া নজর। তোমাকেও অনেকে চেনে, কখ্‌খনো ভেবো না সকলের চোখেই তুমি ধুলো দিতে পারবে। এখন কিছুদিন কি না গেলেই নয়? শেষের দিকে তাহার গলাটা যেন অদ্ভুত শুনাইল।

 ডাক্তার মৃদু হাসিয়া কহিলেন, তুমি ত জানো না গেলেই নয়।

 সুমিত্রা আর কথা কহিলেন না, কিন্তু অপূর্ব্ব ব্যাপারটা একেবারে চক্ষের পলকে বুঝিতে পারিল। তাহার চোখ ও দুই কান গরম হইয়া সর্ব্বাঙ্গ দিয়া যেন আগুন

১২৩