পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৩১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 অপূর্ব্ব অনেকক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া থাকিয়া শেষে আস্তে আস্তে বলিল, কিন্তু এ ছাড়া আর আমার উপায় কি ভারতী?

 ভারতী কহিল, উপায় না থাকতে পারে, কিন্তু এ অসম্ভব আপনি অতি বড় নিষ্ঠাবানের ঘর থেকেও প্রত্যাশা করবেন না। এর ফল কখনো ভাল হবে না। আপনার নিষ্ঠুরতার ফলে যতই সে নিজের কর্ত্তব্য পালন করবে, ততই তার কাছে আপনি ছোট হয়ে যাবেন! স্ত্রীর কাছে অশ্রদ্ধেয়, হীন হওয়ায় বড় দুর্ভোগ সংসারে আর নেই অপূর্ব্ববাবু।

 কথাটা এত বড় সত্য যে অপূর্ব্ব নিরুত্তর হইয়া রহিল। শাস্ত্রমতে স্ত্রীর কর্ত্তব্য কি, পতিব্রতা কাহাকে বলে, নিঃস্বার্থ শাশুড়ী-সেবায় কতখানি মাহাত্ম্য, স্বামীর ইচ্ছামাত্র পালন করার কিরূপ পূণ্য ইত্যাদি নানাবিধ উপাখ্যান বন্ধুমহলে আধুনিকতার বিরুদ্ধে লড়াই করিবার কালে সে শাস্ত্রগ্রন্থাদি হইতে নজির স্বরূপে উদ্ধৃত করিয়া তাহাদের স্তব্ধ করিয়া দিয়াছে, কিন্তু এই খ্রীষ্টান মেয়েটির সম্মুখে তাহার আভাসমাত্রও উচ্চারণ করিতে তাহার মুখ ফুটিল না। খানিক পরে সে কতকটা যেন আপনাকে আপনি বলিল, বাস্তবিক, আজকালকার দিনে এ-রকম মেয়ে বোধ হয় কেউ নেই।

 ভারতী হাসিল, কহিল, একেবারে কেউ নেই তা’ কেমন করে বলবেন? নিষ্ঠাবানের ঘরে না থাকলেও হয়ত আর কোথাও কেউ থাকতে পারে, যে আপনার জন্যে নিজেকে সম্পূর্ণ জলাঞ্জলি দিতে পারে, কিন্তু তাকে আপনারা খুঁজে পাবেন কোথায়?

 অপূর্ব্ব নিজের চিন্তাতেই ছিল, ভারতীর কথায় মন দেয় নাই, কহিল, সে তো বটেই।

 ভারতী জিজ্ঞাসা করিল, আপনি কবে বাড়ি যাবেন?

 অপূর্ব্ব অন্যমনষ্কের মতই জবাব দিল, কি জানি, মা কবে চিঠে লিখে পাঠাবেন। কিছুক্ষণ স্তব্ধভাবে থাকিয়া বলিতে লাগিল, বাবার সঙ্গে মতের অমিল নিয়ে মা আমার কোনদিন জীবনে সুখ ভোগ করেননি। সেই মাকে একলা ফেলে রেখে আসতে আমার কিছুতে মন সরে না। কি জানি, এবার গেলে আর আসতে পারবো কি না। হঠাৎ ভারতীর মুখের প্রতি দৃষ্টি স্থির করিয়া কহিল, দেখুন, বাইরে থেকে দেখতে আমাদের সাংসারিক অবস্থা যতই সচ্ছল হোক ভিতরে কিন্তু বড় অনটন! সহরে অধিকাংশ গৃহস্থের এমনি দশা। বৌদিদিরা যে-কোনদিন আমাদের পৃথক করে দিতে পারেন। আমি ফিরে যদি না আসতে পারি ত আমাদের কষ্টের হয়ত সীমা থাকবে না।

১২৭