পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৩৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 এখন সময় বছর দশ-এগারোর একটি মেয়ে আসিয়া প্রবেশ করিল। সে অঞ্চলের ভিতর হইতে এক বোতল মদ বাহির করিয়া সাবধানে মেঝের উপর রাখিয়া কহিল, বাবা, ঘোড়া মার্কা মদ আর নেই, তাই টুপি মার্কা মদ নিয়ে এলুম। চারটে পয়সা বাকী রইল। দেখ বাবা, রাম আইয়া মাতাল হয়ে আমাকে কি বলছিল জানো?

 প্রত্যুত্তরে তাহার পিতা রামিয়ার উদ্দেশে একটা কদর্য্য ভাষা উচ্চারণ করিল। ভারতী কহিল, ও-সব জায়গায় তুমি আর যেয়ো না। তোমার মা কোথায় সুশীলা?

 মা? মা তো পরশু রাত্তিরে যদুকাকার সঙ্গে বেরিয়ে গিয়ে লাইনের বাইরে ঘর ভাড়া করেছে। মেয়েটা আরও কি বলিতেছিল, কিন্তু বাপ গর্জ্জন করিয়া উঠিল,—করাচ্চি। এ বাবা বিয়ে করা পরিবার, বেউশ্যে নয়! এই বলিয়া সে অনিশ্চিত কম্পিত হস্তে স্ক্রুর অভাবে ভাঙা খুন্তির ডগা দিয়া নূতন বোতলের ছিপি খুলিতে প্রবৃত্ত হইল।

 ভারতী হঠাৎ তাহার অঞ্চল-প্রান্তে একটা প্রবল আকর্ষণ অনুভব করিয়া পিছন ফিরিয়া দেখিল, অপূর্ব্বর মুখ একেবারে ফ্যাকাশে হইয়া গেছে। কখনো সে ভারতীকে স্পর্শ করে নাই, কিন্তু এখন সে জ্ঞানই তাহার ছিল না। কহিল, চলুন এখান থেকে।

 একটু দাঁড়ান।

 না, এক মিনিট না। এই বলিয়া সে একপ্রকার জোর করিয়া তাহাকে বাহিরে আনিল। ঘরের ভিতরে মানিক ছিপি বোতল ও খুন্তির বাঁট লইয়া বীরদর্পে গর্জ্জাইতে লাগিল যে, খুন করিয়া ফাঁসি যাইতে হয় সে ভি আচ্ছা। সে দেশো গুণ্ডার ছেলে, সে জেল বা ফাঁসি কোনটাকেই ভয় করে না।

 বাহিরে আসিয়া অপূর্ব্ব যেন অগ্নিকাণ্ডের ন্যায় জ্বলিয়া উঠিল,—হারামজাদা, নচ্ছার, পাজি মাতাল। যেন পিশাচের নরককুণ্ড বানিয়ে রেখেছে। এখানে পা দিতে আপনার ঘৃণা বোধ হ’ল না?

 ভারতী তাহার মুখের পানে চাহিয়া আস্তে আস্তে বলিল, না। তার কারণ, এ নরককুণ্ড ত এরা বানায়নি। এরা শুধু তার প্রায়শ্চিত্ত করেচে।

 অপূর্ব্ব কহিল, না, এরা বানায়নি আমি বানিয়েচি। মেয়েটার কথা শুনলেন! ওর মা যেন কোন্ তীর্থযাত্রা করেছে। নির্লজ্জ বেহায়া শয়তান। তার কখ্‌খনো যদি এখানে আসবেন ত টের পাবেন বলে দিচ্ছি।

 ভারতী একটুখানি হাসিয়া কহিল, আমি ম্লেচ্ছ ক্রীশ্চান, আমার এখানে আসতে দোষ কি?

১৩২