পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৪৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 কিছুদূরে একজনের কাছে প্রয়োজন ছিল, কিন্তু দ্বারে তাহার তালা দেওয়া দেখিয়া উভয়েই সেই পথেই ফিরিল। কালাচাঁদের ঘরের কাছে আসিয়া দেখিল সেই ‘যমুন। প্রবাহিনী’র গান তখন থামিয়াছে, কিন্তু তৎপরিবর্ত্তে মদ-মত্ত তর্ক একেবারে উদ্দাম হইয়া উঠিয়াছে! একজন স্ত্রীলোক মাতাল হইয়া তাহার স্বামীর শোকে কান্না শুরু করিয়াছে, আর একজন তাহাকে এই বলিয়া সান্ত্বনা দিতেছে যে, দেশের কথা বলিয়া আর লাভ নাই, এইখানেই আবার তোর সব হবে, তুই বরঞ্চ মানত করিয়া পূর্ণিমায় পূর্ণিমায় সত্যনারায়ণের কথা দে। অনেকে এই বলিয়া ঝগড়া করিতেছে যে, এই ক্রীশ্চান মেয়েগুলো কারখানায় ধর্ম্মঘট বাধাইয়া দিতে চায়। তাহা হইলে তাহাদের কষ্টের সীমা থাকিবে না, উহাদের লাইনের ধরে আর আসিতে দেওয়া উচিত নয়। কালাচাঁদ মিস্ত্রী বুঝাইয়া বলিতেছে যে সে বোকা ছেলে নয়। ইহাদের দৌড়টাই কেবল সে দেখিতেছে। একজন অতিসাবধানী মেয়েমানুষ পরামর্শ ছিল যে, খোকা, সাহেবকে এই বেলা সাবধান করিয়া দেওয়া ভাল।

 সেখান হইতে ভারতীকে জোর করিয়া দূরে টানিয়া লইয়া গিয়া অপূর্ব্ব তিক্ত কণ্ঠে কহিল, আর করবে এদের ভাল? নেমকহারাম। হারামজাদা! পাজি! নচ্ছার উঃ—পাশের ঘরে দুটো অনাথ ছেলেমেছে মরে, একজন কেউ চেয়ে দেখে না। নরক আর কোথায়?

 ভারতী মুখপানে চাহিয়া বলিল, হঠাৎ হল কি আপনার?

 অপূর্ব্ব কহিল, আমার কিছুই হয়নি, আমি জানতাম। কিন্তু তুমি শুনলে কি না, তাই বল?

 ভারতী বলিল, নূতন কিছুই নয়, এ রকম তো আমরা রোজ শুনি।

 অপূর্ব্ব গর্জ্জিয়া উঠিয়া কহিল, এমনি শয়তানি? এমনি কৃতঘ্নতা? এদের চাও তুমি দলে আনতে—দলবদ্ধ করতে? এদের চাও তুমি ভাল?

 ভারতীর কণ্ঠস্বরে কোন উত্তেজনা প্রকাশ পাইল না। বরঞ্চ, সে একটুখানি মলিন হাসি হাসিয়া বলিল, এরা কারা অপূর্ব্ববাবু? এরা ত আমরাই। এই ছোট্ট কথাটুকু যখনই ভুলচেন, তখনি আপনার গোল বাধচে। আর ভাল? ভাল করা বলে যদি সংসারে কোন কথা থাকে, তার যদি কোন অর্থ থাকে সে তো এইখানে। ভাল ত ডাক্তারবাবুর করা যায় না অপূর্ব্ববাবু।

 অপূর্ব্ব একথার কোন জবাব দিল না।

 দুজনে নিঃশব্দে ফটক পার হইয়া আবার বর্ম্মী পাড়ার ভিতর দিয়া বাজারের পথ ঘুরিয়া বড় রাস্তায় আসিয়া পড়িল। তখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গেছে, গৃহস্থের ঘরে আলো জ্বলিতেছে, পথের দুধারে ছোট ছোট রাত-দোকান বসিয়া বেচা-কেনা

১৪০