পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৪৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

আরম্ভ হইয়াছে,—ইহারই মধ্যে দিয়া ভারতী মাথার কাপড় কপালের নীচে পর্য্যন্ত টানিয়া দিয়া নিঃশব্দে দ্রুতবেগে পথ হাঁটিয়া চলিল। অবশেষে লোকালয় শেষ হইয়া যেখানে জলা ও মাঠ শুরু হইল, সেইখানে তে-মাথায় আসিয়া সে পিছনে চাহিয়া কহিল, আপনি বাসায় যান ত সহরে যাবার এই ডানদিকের পথ।

 অপূর্ব্ব অন্যমনস্ক হইয়াছিল, জিজ্ঞাসা করিল, আপনি কি বলেন?

 ভারতী বলিল, এতক্ষণে আপনার মাথা ঠাণ্ডা হয়েচে। যথাযোগ্য সম্বোধনের ভাষা মনে পড়েচে?

 তার মানে?

 তার মানে রাগের মাথায় এতক্ষণ আপনি-তুমির ভেদাভেদ ছিল না! এখন ফিরে এল।

 অপূর্ব্ব অতিশয় লজ্জিত হইয়া স্বীকার করিয়া কহিল, আপনি রাগ করেননি?

 ভারতী হাসিয়া ফেলিল। বলিল, একটু করলেই বা। চলুন।

 আবার যাবো?

 যাবেন না ত কি অন্ধকার পথে আমি একলা যাবো?

 অপূর্ব্ব আর দ্বিরুক্তি করিল না! আজ মনের মধ্যে তাহার অনেক বিষ, অনেক জ্বালা দাউ দাউ করিয়া জ্বলিতেছিল। মাতালগুলার কথা সে কোন মতে ভুলিতে পারিতেছিল না। চলিতে চলিতে হঠাৎ কটুকণ্ঠে সে বলিয়া উঠিল, এ সব হ’ল সুমিত্রার কাজ, আপনার ওখানে মোড়লি করতে যাবার দরকার কি? কে কোথায় কি করে বসবে, আর আপনাকে নিয়ে টানাটানি পড়বে।

 ভারতী বলিল, পড়লেই বা।

 অপূর্ব্ব বলিল, বা রে, পড়লেই বা! আসল কথা হচ্চে সর্দ্দারি করাই আপনার স্বভাব। কিন্তু আরো ত ঢের জায়গা আছে।

 একটা দেখিয়ে দিন না।

 আমার বয়ে গেছে।

 খানিকটা খুঁড়িয়া রাস্তার এই স্থানটা মেরামত হইতেছিল। যাইবার সময় দিনের বেলায় কষ্ট হয় নাই, কিন্তু দুপাশের কৃষ্ণচূড়ার গাছের নীচে ভাঙা পথটা অন্ধকারে একেবারে দুর্গম হইয়া উঠিয়াছিল। ভারতী হাত বাড়াইয়া অপূর্ব্বর বাঁ হাতটা শক্ত করিয়া ধরিয়া বলিল, স্বভাব ত আমার যাবে না অপূর্ব্ববাবু, কিছু একটা করাই চাই। কিন্তু আপনার মত আনাড়ির ওপরে মোড়লি করতে পাই ত আমি আর সমস্ত ছেড়ে দিতে পারি।

 আপনার সঙ্গে কথায় পাররার জো নেই। এই বলিয়া সে সাবধানে ঠাওর করিয়া করিয়া পথ চলিতে লাগিল।

১৪১