পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৪৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

একেবারে ভোজবাজির মত সৌভাগ্যের দীপ্তিতে রাঙা হইয়া উঠিবে, তা হইলে যেমন করিয়া হৌক সে দুর্ল্লভ বস্তু তাহাদের সংগ্রহ করিয়া আনিতে হইবে।

 সেদিন বৈকালের সভায় বক্তার অভাবে অপূর্ব্বর মত আনাড়িকেও সনির্ব্বন্ধ উপরোধের তাড়নায় বাধ্য হইয়া দুই-চারিটা কথা দাঁড়াইয়া উঠিয়া বলিতে হইয়াছিল। বলার অভ্যাস তাহার কোনকালে ছিল না, বলিয়াও ছিল সে অতিশয় বিশ্রী এবং এজন্য মনে মনে সে যৎপরোনাস্তি লজ্জিত হইয়াই ছিল, কিন্তু আজ হঠাৎ যখন খবর পাইল তাহদের সেদিনকার বক্তৃতা বৃথা ত হয়ই নাই, বরঞ্চ ফল এতদূর গড়াইয়াছে যে তাহাদের আগামী সভায় সমস্ত কল-কারখানার কাজ বন্ধ করিয়া কারিকরের দল উপস্থিত হইবার সঙ্কল্প করিয়াছে, তখন শ্লাঘায় ও আত্মপ্রসাদের আনন্দে বুকের মধ্যেটা তাহার ফুলিয়া উঠিল। সেদিন নিজের বক্তব্যকে সে পরিস্ফুট করিতে পারে নাই, কিন্তু তাহার ভয় ভাঙিয়াছিল। বহুলোকের মাঝখানে উঠিয়া জনতাকে সম্বোধন করিয়া বলার মধ্যে যে নেশা আছে, সেদিন সে তাহার স্বাদ পাইয়াছিল, আজ অফিসে আসিয়াই সুমিত্রার চিঠির মধ্যে বহুবিধ প্রশংসার সঙ্গে আগামী সভার জন্যও পুনরায় বক্তার নিমন্ত্রণ পাইয়া সে উত্তেজনায় চঞ্চল হইয়া উঠিল। আফিসের কাজে, মন দিতে পারিল না এবং কি করিয়া আরও বিশদ, আরও সতেজ ও আরও সুন্দর করিয়া বলা যায় তখন হইতে মনে মনে তাহার ইহারই মহড়া চলিতে লাগিল। দুপুরবেলা টিফিন খাইতে বসিয়া আজ সে হঠাৎ রামদাসের কাছে এই কথা প্রকাশ করিয়া ফেলিল। একদিন তাহারই জন্য সে ভারতীকে অপমান করিয়াছিল, সেই অবধি তাহার লেশমাত্র সংস্রবের কথাও এই লোকটির কাছে বলিতে অপূর্ব্বর অত্যন্ত লজ্জা করিত। আদালতে সেই জরিমানার দিন হইতে গণনার হিসাবে কত দিনই বা গত হইয়াছে। ইহার মধ্যে সেই দুর্দ্দান্ত বর্ব্বর সাহেবটা মরিয়াছে, তাহার বাঙালী-স্ত্রী মরিয়াছে এবং তাহাদের সেই শয়তান ক্রীশ্চান মেয়েটাও ঘর ছাড়িয়া কোথায় চলিয়া গেছে এইটুকুই শুধু রামদাস জানিত। কিন্তু অবসরটুকুর মধ্যেই যে সেই ঘরছাড়া মেয়েটির সহিত নিঃশব্দ গোপনে তাহার বন্ধুর জীবনে কতবড় কাব্য ও কতবড় দুঃখের ইতিহাস দুঃসহ দ্রুতবেগে রচিত হইয়া উঠিতেছিল সে তাহার কোন খবরই পায় নাই। আজ পুলকের আতিশয্যে সকল কথাই যখন অপূর্ব্ব ব্যক্ত করিয়া কহিতে লাগিল, তখন রামদাস তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া চুপ করিয়া রহিল। ভারতী, সুমিত্রা, ডাক্তারবাবু, নবতারা, এমন কি সেই মাতালটার পর্য্যন্ত উল্লেখ করিয়া সে তাহাদের পথের দাবীর কর্ম্ম ও লক্ষ্য বিবৃত করিয়া সেদিনকার লাইনের ঘরে অভিযানের বিবরণ যখন একটি একটি করিয়া দিতে লাগিল তখন পর্য্যন্তও রামদাস একটি প্রশ্ন করিল না। একদিন দেশের জন্য এই লোকটি জেল খাটিয়াছে, বেত

১৪৩