পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৫২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ঠেলা-ঠেলি করিয়া পলাইবার চেষ্টা করিতেছে। এবং তাহাকেই দুইভাগে বিভক্ত করিয়া পিষিরা মাড়াইয়া প্রকাণ্ড বড়-বড় ঘোড়ায় চড়িয়া বিশ-পঁচিশজন গোরা পুলিশ কর্ম্মচারী দ্রুতবেগে অগ্রসর হইয়া আসিতেছে। তাহাদের একহাতে লাগাম এবং অন্যহাতে চাবুক,—কোমরবন্ধে পিস্তল ঝুলিতেছে। তাহাদের কাঁধের লোহার জাল ঝক্ ঝক্ করিতেছে এবং রাঙা মুখ ক্রোধে ও অস্তমান সূর্য্যকিরণে একেবারে সিঁদুরের মত লাল হইয়া উঠিয়াছে। যে ব্যক্তি বক্তৃতা দিতেছিল তাহার বজ্রকণ্ঠ হঠাৎ কখন নীরব হইল এবং মঞ্চ হইতে নীচের ভিড়ের মধ্যে চক্ষের পলকে সে যে কি করিয়া কোথায় অদৃশ্য হইল জানা গেল না।

 সর্দ্দার গোরা মঞ্চের ধার ঘেঁষিয়া আসিয়া কর্কশকণ্ঠে কহিল, মিটিং বন্ধ করিতে হইবে।

 সুমিত্রা এখনও আরোগ্য লাভ করিতে পারে নাই, তাহার উপবাস-ক্লিষ্ট মুখের ’পরে পাণ্ডুর ছায়া পড়িল, কিন্তু তৎক্ষণাৎ উঠিয়া দাঁড়াইয়া জিজ্ঞাসা করিল, কেন?

 সে কহিল, হুকুম।

 কার হুকুম?

 গভর্ণমেণ্টের।

 কিসের জন্য?

 স্ট্রাইক করার জন্য মজুরদের ক্ষ্যাপাইয়া তোলা নিষেধ।

 সুমিত্রা বলিল, বৃথা ক্ষেপিয়ে দিয়ে তামাসা দেখবার আমাদের সময় নেই। ইউরোপ প্রভৃতি দেশের মত এদের দলবদ্ধ হওয়ায় প্রয়োজনীয়তা বুঝিয়ে দেওয়াই এই মিটিংএর উদ্দেশ্য।

 সাহেব চমকিয়া কহিল, দলবদ্ধ করা? ফার্ম্মের বিরুদ্ধে! সে তো এদেশে ভয়ানক বে-আইনি। তাতে নিশ্চয় শান্তিভঙ্গ হতে পারে।

 সুমিত্রা কহিল, নিশ্চয়, পারে বই কি! যে দেশে গভর্ণমেণ্ট মানেই ইংরাজ ব্যবসায়ী এবং সমস্ত দেশের রক্ত শোষণের জন্যই যে দেশে এই বিরাট যন্ত্র খাড়া করা—

 বক্তব্য তাহার শেষ হইতে পাইল না, গোরার রক্তচক্ষু আগুন হইয়া উঠিল। ধমক দিয়া বলিল, দ্বিতীয়বার এ-কথা উচ্চারণ করলে আমি অ্যারেস্ট করতে বাধ্য হব।

 সুমিত্রার আচরণে এতটুকু চাঞ্চল্য প্রকাশ পাইল না, শুধু ক্ষণকাল তাহার মুখের প্রতি একদৃষ্টে চাহিয়া মুচকিয়া একটু হাসিল। কহিল, সাহেব, আমি অসুস্থ এবং অতিশয় দুর্ব্বল। না হলে তবু দ্বিতীয়বার কেন, এ কথা একশবার চীৎকার করে এই লোকগুলিকে শুনিয়ে দিতাম। কিন্তু আজ আমার শক্তি নেই। এই বলিয়া সে আবার একটু হাসিল।

১৪৮