পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৫৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 ভারতী আশ্চর্য্য হইয়া বলিল, সন্ন্যাসী? কিন্তু মা তো বেঁচে আছেন।

 অপূর্ব্ব কহিল, হ্যাঁ। দেশের পল্লীগ্রামে আমাদের একটা ছোট বাড়ি আছে, মাকে আমি সেইখানেই নিয়ে যাব।

 তারপরে?

 আমার যে এক হাজার টাকা আছে তাই দিয়ে একটা ছোট মুদির দোকান খুলবো। আমাদের দুজনের চলে যাবে।

 ভারতী কহিল, তা যেতে পারে। কিন্তু হঠাৎ এর দরকার হল কিসে?

 অপূর্ব্ব বলিল, আজ আমি নিজেকে চিনতে পেরেছি। শুধু মা ছাড়া সংসারে আমার দাম নেই। ভগবান করুন এর বেশি যেন না আমি কারো কাছে কিছু চাই।

 ভারতী পলকমাত্র তাহার মুখের পানে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিল, মা আপনাকে বুঝি বড্ড ভালবাসেন?

 অপূর্ব্ব কহিল, হ্যাঁ। চিরকাল মার দুঃখে দুঃখেই কাটলো, কেবল ভয় হয় তা আর যেন না বাড়ে। আমার সকল কাজে-কর্ম্মে আমার আধখানা যেন মা হয়ে আমার আর আধখানাকে দিবারাত্রি আঁকড়ে ধরে থাকে। এ থেকে আমি এক মুহূর্ত্ত ছাড়া পাইনে, ভারতী, তাই আমি ভীতু, তাই আমি সকলের অশ্রদ্ধার পাত্র। এই বলিয়া তাহার মুখ দিয়া সহসা দীর্ঘনিশ্বাস পড়িল।

 ইহার জবাব ভারতী দিল না, কেবল হাতবানি তাহার ধীরে ধীরে অপূর্ব্বর হাতের মধ্যে ধরা দিয়া নীরবে পথ চলিতে লাগিল।

 সন্ধ্যার অন্ধকার গাঢ় হইয়া আসিতেছিল, অপূর্ব্ব উদ্বিগ্নকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, রামদাসের পরিবারের কি উপায় করবে ভারতী? শুধু দাসী ছাড়া এদেশে তাদের দেশের লোক বোধ করি কেউ নেই। থাকলেই বা কেউ কি তাদের ভার নেবে?

 ভারতী নিজেও কিছু ভাবিয়া পায় নাই, শুধু সাহস দেবার জন্যই কহিল, চলুন ত দিয়ে দেখি। উপায় একটা হবেই।

 অপূর্ধ্ব বুঝিল ইহা ফাঁকা কথা। তাহার মন কোন সান্ত্বনাই মানিল না, কহিল, তোমাকে হয়ত সেখানে থাকতে হবে।

 কিন্তু আমি ত ক্রীশ্চান, তাঁদের কি কাজেই বা লাগবো?

 তা বটে। কথাটা নূতন করিয়া অপূর্ব্বর বিঁধিল।

 উভয়ে বাসার আসিয়া যখন পৌঁছিল তখন সন্ধ্যা বহুক্ষণ উত্তীর্ণ হইয়া গেছে। এই রাত্রে কেমন করিয়া যে কি হইবে চিন্তা করিয়া মনে মনে তাহাদের ভয় ও উদ্বেগের সীমা ছিল না। নীচের ঘর খোলা ছিল, ভিতরে পা দিয়াই ভারতী দেখিতে

১৫৫