ডাক্তার ইহার উত্তর দিলেন না।
অপূর্ব্বর মনের মধ্যে কেবল একটা কথা তোলা-পাড়া করিতেছিল, সে তাহারই সূত্র ধরিয়া বলিল, সমিতির সভ্য না হয়েও রামদাস যে শাস্তি ভোগ করতে যাচ্চে তা অসাধারণ।
ডাক্তার কহিলেন, শাস্তি নাও হতে পারে।
অপূর্ব্ব কহিল, না হয় ত সে তার ভাগ্য। কিন্তু যদি হয় সমস্ত অপরাধ আমার। আমিই তাকে এনেছিলাম।
প্রত্যুত্তরে ডাক্তার শুধু মুচকিয়া হাসিয়া চুপ করিলেন।
অপূর্ব্ব কহিতে লাগিল, দেশের জন্য যে ব্যক্তি দু বছর জেল খেটেছে, অসংখ্য বেতের দাগ যার পিঠ থেকে আজও মোছেনি, এই বিদেশে স্ত্রী-পুত্র যার শুধু তারই মুখ চেয়ে আছে তার এতবড় সাহস অসামান্য। ওর আর তুলনা নেই।
তাহার বন্ধুর প্রতি উচ্ছ্বসিত এই অকৃত্রিম প্রশংসা-বাক্যের মধ্যেও একটা গোপন আঘাত ছিল, কিন্তু তাহা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হইল। ডাক্তার মুখ উজ্জ্বল করিয়া কহিলেন, তাতে আর সন্দেহ কি অপূর্ব্ববাবু। পরাধীনতার আগুনে বুকের মধ্যে যার অহোরাত্র জ্বলে যাচ্ছে, এ ছাড়া তার তো উপায় নেই। সাহেবের দোকানের বড় চাকরি বা ইন্সিনের বাসায় স্ত্রী-পুত্র-পরিবার কিছুই তাকে ঠেকাতে পারে না,—এই তার একটিমাত্র পথ।
দুশ্চিন্তা ও তীব্র সংশয়ে অপূর্ব্বর বুদ্ধি ও জ্ঞান আচ্ছন্ন হইয়া না থাকিলে সে এত বড় ভুল করিতে পারিত না। ডাক্তারের উক্তিকে সে শ্লেষ কল্পনা করিয়া হঠাৎ যেন ক্ষেপিয়া গেল। কহিল, আপনি তাঁর মহত্ত্ব অনুভব না করতে পারেন, কিন্তু সাহেবের দোকানের চাকরি তলওয়ারকরের মত মানুষকে ছোট করে দিতে পারে না। আমাকে আপনি যত ইচ্ছে ব্যঙ্গ করুন, কিন্তু রামদাস কোন অংশেই আপনার ছোট নয়। এ আপনি নিশ্চিত জানবেন।
ডাক্তার আশ্চর্য্য হইয়া কহিলেন, আমি নিশ্চিতই জানি। তাঁকে আমি ছোট বলিনি অপূর্ব্ববাবু!
অপূর্ব্ব কহিল, বলেছেন। তাঁকে এবং আমাকে আপনি পরিহাস করেছেন। কিন্তু আমি জানি জন্মভূমি তার প্রাণাপেক্ষা প্রিয়। সে নির্ভীক! সে বীর! আপনার মত সে লুকিয়ে বেড়ায় না। আপনার মত পুলিশের ভয়ে ছদ্মবেশে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলে না। আপনি ত ভীরু।
প্রচণ্ড বিস্ময়ে ভারতী অবাক হইয়া গিয়াছিল, কিন্তু আর সে সহিতে পারিল না। দৃপ্তকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, আপনি কাকে কি বলছেন অপূর্ব্ববাবু? হঠাৎ পাগল হয়ে গেলেন কি?
১৫৮