পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৬৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

এমন কি রাতারাতি এখান থেকেও অন্তর্হিত হতে হ’ল। রামদাস কহিল, সেদিন রেলওয়ে স্টেশনে আপনাকে চিনতে পেরেছিলাম।

 ডাক্তার ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, জানি। কিন্তু সোজা বাসায় না গিয়ে এত রাত্রে এখানে কেন?

 রামদাস কহিল, আপনাকে প্রণাম করতে। পুনার সেণ্ট্রাল জেলে আমি যাবার পরেই আপনি চলে গেলেন। তখন সুযোগ পাইনি। নীলকান্ত যোশীর কি হ’ল জানেন? সে তো আপনার সঙ্গে ছিল।

 ডাক্তার মাথা নাড়িয়া বলিলেন, হ্যাঁ। ব্যারাকের পাঁচিল টপকাতে পারলে না বলে সিঙ্গাপুরে তার ফাঁসি হ’ল।

 অপূর্ব্বর কাছে এই সকল অচিন্ত্যনীয়, অদ্ভুত দুঃস্বপ্নের মত বোধ হইতে লাগিল। সে আর থাকিতে না পারিয়া অকস্মাৎ জিজ্ঞাসা করিয়া উঠিল, ডাক্তারবাবু, আপনারও কি তাহলে ফাঁসি হতো?

 ডাক্তার তাহার মুখের দিকে চাহিয়া একটু হাসিলেন। এই হাসি দেবিৱা অপূর্ব্বর মাথায় চুল পর্য্যন্ত শিহরিয়া উঠিল।

 রামদাস উৎসুক হইয়া কহিল, তার পরে?

 ডাক্তার বলিলেন, একবার এই সিঙ্গাপুরেই আমাকে বছর তিনেক আটক থাকতে হয়েছিল, কর্ত্তৃপক্ষরা আমাকে চেনেন। তাই সোজা-রাস্তাটা এড়িয়ে ব্যাঙ্ককের পথে পাহাড় ডিঙ্গিয়ে টেভয়ে এসে পৌঁছুলাম। জোর কপাল! হঠাৎ বনের মধ্যে একটা হাতীর বাচ্চাও ভগবান পাইয়ে দিলেন। সেটা সঙ্গে থাকায় বরাবর ভারি সুবিধে হয়ে গেল। শেষে হাতীর বাচ্চা বিক্রী করে দেশী জাহাজে নারকেল চালানের সঙ্গে নিজেকে চালান দিয়ে মাস তিনেকের মধ্যে একেবারে আরাকানে এসে পাড়ি জমালাম। খাসা থাকা গিয়েছিল রামদাসবাবু, হঠাৎ থানার মধ্যে আজ পরম বন্ধুর সঙ্গে মুখোমুখি দেখা সাক্ষাৎ। ভি. এ. চেলিয়া তাঁর নাম, বড্ড স্নেহ করেন আমাকে। বহুদিনের অদর্শনে খুঁজতে খুঁজতে একেবারে সিঙ্গাপুর থেকে বুর্ম্মা মুলুকে এসে উপস্থিত হয়েছেন। ভাবে বোধ হয় খোঁজ পেয়েচেন। তবে, ভিড়ের মধ্যে তেমন নজর দিতে পারেননি, নইলে পৈতৃক গলাটার,—এই বলিয়া তিনি হাঃ হাঃ করিয়া হাসিতে গিয়া অকস্মাৎ অপূর্ব্বর মুখের দিকে চাহিয়া একেবারে চমকিয়া উঠিলেন,—এ কি অপূর্ব্ববাবু? কি হ’ল আপনার?

 অপূর্ব্ব, দাঁতে ঠোঁট চাপিয়া আপনাকে সামলাইবার চেষ্টা করিতেছিল। তাহার কথা শেষ না হইতেই সে দুই হাতে মুখ ঢাকিয়া সবেগে ঘর হইতে ছুটিয়া বাহির হইয়া গেল।

১৬১