ভারতী বলিল, তাই যদি হয় ত আপনার চেয়ে বড় ডাক্তারই বা পৃথিবীতে আছে কে?
ডাক্তার রহস্যভরে জবাব দিলেন, তাহলেই হয়েচে! দীর্ঘ অভ্যাসে ও-বিদ্যে ত মন থেকে ধুয়ে-মুছে গেছেই, তা ছাড়া বসে বসে কারও চিকিৎসা করি সে সময়ই বা কই?
কথা তাঁহার শেষ না হইতেই ভারতী বলিয়া উঠিগ, সময় কই। সময় কই! কেউ মরে গেলেও সময় হবে না—এমনি দেশের কাজ? দেখুন ডাক্তারবাবু, বিদ্যে মুছে যাবার মন ও নয়; মুছে যদি সত্যিই কিছু গিয়ে থাকে ত সে দয়া-মায়া!
ডাক্তারের হাসি-মুখ কেবল মুহূর্ত্তের তরে গম্ভীর হইয়াই পুনরায় পূর্ব্বশ্রী ধারণ করিল। কিন্তু তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ভারতী সেই এক মুহূর্ত্তেই নিজের ভুল বুঝিতে পারিল। তাহাদের ঘনিষ্ঠতা বহুদূর পর্য্যন্ত গিয়াছে সত্য, কিন্তু এদিকে অঙ্গুলি সঙ্কেত করিবার অধিকার আজও তাহার ছিল না। বস্তুতঃ, সুমিত্রা কে, ডাক্তারের সহিত তাহার কি সম্বন্ধ এবং কবে কি করিয়া সে যে এই দলভুক্ত হইয়া পড়িল অদ্যাবধি ভারতী তাহার কিছুই জানিত না। তাহাদের সম্প্রদায়ে ব্যক্তিগত পরিচয় সম্বন্ধে কৌতূহলী হওয়া একান্ত নিষিদ্ধ। সুতরাং অনুমান ভিন্ন সঠিক কিছুই জানিবার তাহার উপায় ছিল না। শুধু মেয়েমানুষ বলিয়াই সে সুমিত্রার মনোভাব উপলব্ধি করিয়াছিল। কিন্তু নিজের সেই অনুভূতিটুকুমাত্র ভিত্তি করিয়া অকস্মাৎ এতবড় ইঙ্গিত ব্যক্ত করিয়া ফেলিয়া সে শুধু সঙ্কুচিত নয়, ভয়ও পাইল। ভয় ডাক্তারকে নয়,—সুমিত্রাকে। একথা কোন মতেই তাহার কানে উঠিলে চলিবে না। তাঁহার অন্য পরিচয় জানা না থাকিলেও প্রথম হইতেই সেই নিস্তব্ধ তীক্ষ্ণবুদ্ধিশালিনী রমণীর দুর্ভেদ্য নিরিড়তার পরিচয় কাহারও অবিদিত ছিল না। তাঁহার স্বল্পভাষণে, তাঁহার প্রখর সৌন্দর্য্যের প্রতি পদক্ষেপে, তাঁহার অবহিত রাক্যালাপে, তাঁহার অচঞ্চল আচরণের গাভীর্য্যে ও গভীরতায় এই দলের মধ্যে বাকিরাও তাঁহার অপরিসীম দূরত্ব স্বতঃসিদ্ধের মতই যেন সকলে অনুভব করিত। এমন কি তাঁহার অসুস্থতা লইয়াও গায়ে পড়িয়া আলোচনা করিতেও কাহারো সাহস হইত না। কিন্তু একদিন সেই দুর্লঙ্ঘ কঠোরতা ভেদ করিয়া তাঁহার অত্যন্ত গোপন দুর্ব্বলতা যেদিন অপূর্ব্ব ও ভারতীর সম্মুখে প্রকাশ হইয়া পড়িয়াছিল, যেদিন একজনের বিদায়ের ক্ষণে সুমিত্রা নিজেকে সংবরণ করিতে পারে নাই, সেদিন হইতেই সে যেন সকলের হইতে আরও বহুদূরে আপনাকে আপনি সরাইয়া লইয়া গেছে। সেই দীর্ঘায়ত ব্যবধান অপরের অযাচিত সহানুভূতির আকর্ষণে সঙ্কুচিত হইবার আভাসমাত্রেই যে তাহার সেই আত্মাশ্রয়ী
১৬৫